
ইতিহাস অতি নিষ্ঠুর, জটিল, কুটিল তার গতি প্রকৃতি বোঝা দায়। যে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম প্রধান নায়ক, যিনি হতে চেয়ে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইসলামের সেই হৃদয়ের টুকরো পাকিস্তান ভাঙার সম্পূর্ণ দায় তাঁর মাথার উপর চাপিয়ে তাঁকে বানানো হ’ল পাকিস্তান ভেঙে গড়ে তোলা বাংলাদেশের জাতির জনক।
যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে হাজার হাজার হিন্দু যুবক হাসি মুখে প্রাণ দিচ্ছিল, হাজার হাজার হিন্দু দেশ প্রেমিক কারা অন্তরালে কাঁদছিল, হাজার হাজার আহত পঙ্গু যুবক মৃত্যুর দিন গুনছিল তখন যুবক শেখ মুজিব স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে হিন্দুদের প্রতি জেহাদের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। এভাবে জেহাদের ডাক দিয়ে তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন আর ব্রিটিশের দেশ ভাগ চক্রান্তে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট থেকে কলকাতায় তিন দিন ধরে চলে হাজার হাজার হিন্দু-জবাই যজ্ঞ এবং হিন্দু মহিলাদের গণধর্ষণ করে হত্যা। এই জবাই-যজ্ঞে শেখ মুজিব সুরাবর্দির সুযোগ্য প্রধান সেনাপতি এবং ডান হাত হয়ে উঠেন।
তবুও হিন্দুরা অতীত বুকে চাপা দিয়ে দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে আওয়ামি লিগকে জেতাতে কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, শ্রম অর্থ বুদ্ধি ও কর্মীসহ এগিয়ে এল।
৭ই মার্চ রমনা মাঠের ঐতিহাসিক জন সভায় লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে স্লোগান উঠল মুজিব তুমি স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা কর। জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ। মুজিব নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পরে সভায় এলেন এবং স্বাধীন বাংলার ডাক দিলেন না, জনগণের মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সেই ডাক উঠল। মুহূর্তের মধ্যে তা সমস্ত গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল এবং ২৫শে মার্চ রাত ১১টায় যখন খান সেনারা ঢাকা আক্রমণ করেছিল তখন ঢাকায় মুজিবর রহমানের বাড়িতে তাজুদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, আবদুস সামাদ, শেখ মণি, তোফায়েল আহমেদ, নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল রেজ্জাক প্রভৃতি আওয়ামি লিগ নেতারা মুজিবর রহমানের সঙ্গে মিটিং করছিলেন। মুজিবরের আদেশে এক ঘণ্টা সময় পেয়ে সবাই আণ্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেলেন কিন্তু কারো অনুরোধেই শেখ মুজিব নিজে আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেলেন না বরং বন্দি হয়ে জামাই আদরে ইসলামাবাদ চলে গেলেন কিন্তু যাবার পূর্বে স্বাধীনতা ঘোষণা-পত্রে স্বাক্ষর করে গেলেন না।
চট্টগ্রামের এক অখ্যাত বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান।
সুসজ্জিত খান সেনাদের দা খোস্তা বঁটি দিয়ে হাজার বছরেও পরাস্ত করা যাবে না এটা জেনেও মুজিবর রহমান ভারতের সাহায্য নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
তবু দেশ স্বাধীন হ’লে মুজিবর রহমান ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের প্রধান হয়েও ইসলামাবাদ থেকে ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই ঘোষণা করলেন বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ এবং যে ইন্দিরা গান্ধী এক বিশ্ব যুদ্ধের হুমকি মাথায় নিয়ে, আমেরিকা, চীন, বৃটেনের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা ক’রে সতের হাজার ভারতীয় সৈন্যের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন ঢাকার রমনা মাঠে তাজুদ্দিন সাহেব নির্মিত পাকা পোক্ত ও স্থায়ী যে ইন্দিরা মঞ্চটি যুগ যুগ ধরে পরবর্তী কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে-ভারতের জনগণ তার প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিত সেই মঞ্চ ভাঙার নির্দেশ দিলেন অপদস্থ করে তাড়িয়ে দিলেন তাঁকে যে জনাব তাজুদ্দিনের সুদক্ষ কূটনীতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হল, যিনি নিজে সরকারের প্রধান না হয়ে মুজিবকে প্রধান করলেন। তাঁর অপরাধ তিনি কাফের দেশের সাহায্য নিয়ে ইসলামিক পাকিস্তানকে ভেঙেছেন-মন্ত্রী সভায় বসালেন- মোস্তাক আহমেদকে যিনি কলকাতায় বসে পাকিস্তানের চর হিসাবে মুজিবর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ নামক ছোট শিশুটি যাতে না জন্মাতে পারে সেই চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন।
মুক্তি যুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালি নিহত হলেন, তার মধ্যে ২৫ লক্ষ হিন্দু। তাদের ১০ লক্ষ বাচ্চা মারা যায় এবং ১০ লক্ষ হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। শেখ মুজিব স্বাধীনতা ইতিহাসে তাদের নাম রাখলেন না। নাম রাখলেন না চিত্ত সুতার, ডাঃ কালিদাস বৈদ্যদের যাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মধ্যস্থতা ক’রে দেশ স্বাধীন করলেন বরং তিনি খুনী রাজাকার, আলবদর, আল সামাস ও আনসারদের শাস্তি না দিয়ে তাঁদের বিনা বিচারে ঢালাও মুক্তি দিলেন। এটা তাঁর উদারতা নয়, বোকামিও নয়। এটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যার পুরস্কার। এর মাধ্যমে তিনি যে বিদ্বেষের বীজ বপন করেছিলেন ক্রমে তা মহীরুহ রূপ ধারণ করল। বাংলাদেশ পরিণত হল সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধদের বধ্য ভূমিতে।
তা দেখে মাননীয় ফ্রাংক প্যালন, সদস্য আমেরিকান কংগ্রেস বললেন বাংলা দেশে হিন্দুদের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার হচ্ছে সেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদিদের উপর অত্যাচারও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
লেখক মুক্তি যুদ্ধে নিজের অভিজ্ঞতা ও সমসাময়িক পূর্বা পর পত্র পত্রিকা, বই পত্রে দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে এ রকম অনেক তথ্য উদ্ধার করেছেন যাতে প্রমাণ হয় শেখ মুজিব বাংলাদেশ চাননি।
“শেখ মুজিব বাংলাদেশ চাননি “কিশোর বিশ্বাসের ৭ম উপন্যাস। সহজ ও সরল সত্যতায় এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের পটভূমি দুই বাংলায় প্রোথিত। কাহিনীর বিন্যাস সাবলীল সত্যে গুণান্বিত। কাহিনী অনায়াসে হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে অনুভূত হয়। সেই আঙ্গিকে মুক্তি যুদ্ধের কিছু অজানা দিগন্ত খুলে গেল, উপন্যাসটির সেটাই বৈশিষ্ট্য। কাহিনীতে ভাঙা আছে, গড়া আছে, সুখ আছে, দুঃখ আছে কিন্তু পড়তে পড়তে এক ঘেয়েমি লাগে না। লেখক মুন্সিয়ানায় সেটা উতরে দিয়েছেন। নানা উথাল পাথালের মধ্যে তরতরিয়ে এগিয়ে চলে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী, জানান দিয়ে যায় মানুষের মনের মণিকোঠায়। সেখানেই সাহিত্যের সফল মাপকাঠি তবু বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের সত্য দিককে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব পাঠক কুলের। সেই প্রত্যাশা রেখে কামনা করি সফল হোক স্রষ্টার সাহিত্য কর্ম।
লিখেছেন,
সুভাষ চক্রবর্তী
সম্পাদক ‘মায়ের ডাক’ পত্রিকা
লেখাটা সংগ্রহ করা হয়েছে,
কিশোর বিশ্বাসের “শেখ মুজিব বাংলাদেশ চাননি” বইয়ের ভূমিকা থেকে।