তাজমহল নাকি তেজোমহালয় শিবমন্দির?

ছবি: তাজমহল।

আজকের তাজমহল যে এককালে শিবমন্দির ছিল তার কিছু প্রমাণ-

১। তাজমহলের প্রধান গম্বুজের শীর্ষদেশের ধাতব চূড়ায় বা pinnacle-এ রয়েছে ত্রিশূল, যা অভ্রান্তভাবে ভগবান মহাদেবের অস্ত্র ও প্রতীক।

২। বটেশ্বর শিলালিপিতে এই মন্দিরকে অতীব শোভন বলা হয়েছে। তা এতই সুন্দর যে সেই মন্দিরকে বাসস্থান হিসাবে পেয়ে ভগবান মহাদেব তাঁর আবাস কৈলাসে ফিরে যাবার বাসনা পরিত্যাগ করেছেন। একমাত্র তাজমহলের সৌন্দর্যই বটেশ্বর শিলালিপিতে বর্ণিত মন্দিরের সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলে।

৩। তাজ-পরিসরের মধ্যে যে বাগান আছে তার সমস্ত গাছ-গাছড়া হিন্দুর কাছে পবিত্র। সেই বাগানে বেল ও হরশৃঙ্গার গাছের অস্তিত্ব বিশেষভাবে লক্ষণীয় কারণ বেলপাতা ও হরশৃঙ্গার ফুল ছাড়া শিবের পূজা হয় না।

৪। তাজমহলে দুই তলায় কবর রয়েছে—উপরের তলায় নকল কবর এবং নিচের তলায় আসল কবর। দুই তলায় কবর সমন্বিত আর কোন মুসলীম কবরখানা নেই। কিন্তু দুই তলায় শিবলিঙ্গ বিশিষ্ট শিবমন্দির উজ্জয়িনী ও ভারতের অন্যান্য জায়গায় বিদ্যমান।

৫। মুসলীম কবরখানায় কেউ কবরকে প্রদক্ষিণ করে না। কিন্তু তাজমহলে কবর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা আছে। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এককালে ভক্তরা সেই পথে শিবলিঙ্গকে প্রদক্ষিণ করত।

৬। তাজমহলের প্রধান গম্বুজের ছাদ থেকে ঝুলছে একটা শিকল, যার সঙ্গে কবরখানার কোনই সম্পর্ক নেই। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকেরা সেই শিকলের সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব ঝুলিয়ে দিয়েছে। এককালে ঐ শিকলের সঙ্গে ঝোলানো ছিল একটি মঙ্গল ঘট, যার থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ত। আজও তাজ দেখাবার সময় গাইডরা পর্যটকদের বলে যে, বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টির জল ফোঁটা ফোঁটা করে কবরের উপরে পড়ে। এটা আর কিছুই নয়, সাবেক কালের শিবলিঙ্গের ওপর জল পড়ার স্মৃতিই প্রবাদে পরিণত হয়েছে মাত্র।

৭। তাজমহলের প্রধান গম্বুজের নিচে আওয়াজ করলে তা অনেকক্ষণ ধরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, যা একটা কবরখানার পক্ষে খুবই বেমানান। কারণ কবরখানায় নীরবতা ও নিস্তব্ধতা পালন করাই রীতি। কিন্তু শিব মন্দির বা যে কোন হিন্দু মন্দিরের পক্ষে এই প্রতিধ্বনি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেবতার উদ্দেশে সংস্কৃত স্তবস্তুতি করলে তা প্রতিধ্বনিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আজ পর্যটকরা নানা রকম শব্দ করে এই প্রতিধ্বনি পরীক্ষা করেন। কিন্তু যদি তাঁরা ওঁ কিংবা ‘হর হর ব্যোম্ ব্যোম্’ বলেন, তবে খুব সহজেই প্রতিধ্বনির পার্থক্য বুঝতে পারবেন।

৮। তাভার্নিয়ে তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখে গেছেন যে, সেই সময় তাজপরিসরের মধ্যে বাজার বসত। একমাত্র হিন্দুর মন্দিরেই বাজার বসে, যেখানে ফুল, ফল, প্রসাদ ও আরও নানান রকম জিনিস বেচা-কেনা হয়। কালীঘাট, পুরী, দক্ষিণেশ্বর, মাদুরাই ইত্যাদি মন্দিরের বাজার তারই নমুনা। ভক্তরা এই বাজার থেকে তীর্থ করার স্মারক হিসাবে নানা জিনিস কিনে নিয়ে যায়। কোন মুসলীম কবরখানায় কোন দিনও বাজার বসে না।

৯। তাজমহলের ডান দিকে, লাল পাথরের মেঝেতে, শীর্ষদেশের ধাতব চূড়াটির একটি প্রতিকৃতি আঁকা আছে। তাতে ত্রিশূল ছাড়াও মঙ্গলঘট, আম্রপল্লব ইত্যাদি হিন্দুচিহ্ন রয়েছে, যা কোন মুসলমানী কবরখানায় থাকার কথা নয়। এই ধাতব চূড়াটি শাহজাহানের পক্ষে পাল্টানো সম্ভব হয়নি, কারণ তাহলে মূল গম্বুজটাকেই ভাঙতে হবে। তাই কোনক্রমে ত্রিশূলের গায়ে আরবীতে ‘আল্লা’ শব্দ খোদাই করে তাকে একটা ইসলামী রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

১০। অনেকের মতে তাজমহলে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের বিশেষ নাম ছিল তেজোলিঙ্গ, যেমন সোমনাথের মন্দিরের শিবলিঙ্গের নাম জ্যোতির্লিঙ্গ। তাদের মতে তেজোলিঙ্গ থেকে মন্দিরের নাম হয় তেজোমহালয়, যা থেকে আজকের তাজমহল নাম এসেছে। অনেকের মতে এই শিবলিঙ্গের আরেক নাম ছিল ‘অগ্রেশ্বর মহাদেব’, যা থেকে আগ্রা শহরের নামকরণ হয়েছে।

১১। আগেই বলা হয়েছে, যেই বেগমের কবরের উপর তাজমহল নির্মিত হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে, সেই বেগমের নাম ছিল আরজুমন্দ বানু। তাকে মমতাজ-উল-জামানি বলেও ডাকা হত। কোন মুসলমান ঐতিহাসিকের রচনার মধ্যে তার মমতাজ মহল নাম পাওয়া যায় না। তাই অনেকে মনে করেন যে, তেজোমহালয়কে তাজমহল করার পর তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করার জন্য মৃত বেগমের নামও একটু পাল্টে ‘মমতাজ মহল’ করা হয়েছে। যদি ঐ বেগমের নামেই তাজের নাম রাখা হত তা ‘মমতাজ মহল’ রাখাই অধিকতর সঙ্গত ছিল এবং ‘মম’ বাদ দেবার কোন প্রয়োজন হোত না। আমরা জানি যে, কোন মানুষের জন্য স্মৃতিসৌধ বানালে সেই মানুষের নামেই সৌধের নাম হয়। কিন্তু তাজমহলের ব্যাপারে ঘটনা ঘটেছে ঠিক উল্টো। আগে তেজোমহালয় থেকে তাজমহল নামকরণ করা হয়েছে এবং সেই তাজমহলের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বেগমের নাম পাল্টে মমতাজ মহল করা হয়েছে।

১২। তাজমহলের প্রধান ফটকের উপরে রয়েছে নহবৎখানা, এককালে সেখান থেকে সকাল-সন্ধ্যায় শানাই বাজানোর রীতি ছিল। কোন কবরখানায় নহবৎখানার অস্তিত্ব খুবই বেমানান। কারণ কবরখানায় নিস্তব্ধতা রক্ষা করাই নিয়ম।

১৩। বিশাল জায়গা জুড়ে এক সুবৃহৎ পরিসরে (কমপ্লেক্সে) তাজ অবস্থিত। চারপাশে এবং মাটির তলায় রয়েছে অনেক বাড়ীঘর, দালান কোঠা। এই তাজ পরিসরের সঙ্গে আর কোন মুসলীম কবরখানার মিল নেই। মিল আছে পুরী, মাদুরাই, রামেশ্বরম ইত্যাদি স্থানের বিশাল মন্দির পরিসরগুলোর সঙ্গে। চারপাশের এই সব দালান-কোঠার কোনটা অতিথিশালা, কোনটা গোশালা, কোনটা ভাণ্ডার, কোনটা রন্ধনশালা, কোনটা ঠাকুর-চাকর ও রক্ষীদের বাসস্থান, কোনটা বা কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

১৪। তাজমহলের নিচের তলায়, যেখানে মমতাজের দেহ শায়িত আছে বলা হয়ে থাকে, একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তার নিচেও আর একটি তলা আছে। সেখানেও অনেক ঘর ও যমুনা পর্যন্ত বারান্দা আছে। ঐ বারান্দা দিয়ে যমুনার বাতাস ও আলো ঐ ঘরগুলোর মধ্যে ঢুকতো। বর্তমানে সেই সব ঘর, বারান্দা ইত্যাদিকে সীল করে দেওয়া হয়েছে। অনেকের বিশ্বাস, ঐ সব সীলকরা ঘরের মধ্যে সাবেক আমলের বিভিন্ন মূর্তি, বিগ্রহ এবং আরও অনেক হিন্দু নিদর্শন ভেঙেচুরে গাদা করে রাখা আছে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ্ শ্রী এস. আর. রাও আগ্রার আর্কিওলজিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। সেই সময় তাজের দেওয়ালে একটা ফাটল দেখা দেয় এবং সেটা পরীক্ষা করার জন্য একটু খুঁড়তেই দেওয়ালের ভিতর থেকে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি বেরিয়ে পড়ে। অতি দ্রুত ব্যাপারটাকে ধামা চাপা দেওয়া হয়। সেই সময় নেহরু সরকারের নির্দেশে নিচের তলায় যাবার রাস্তা নতুন দেওয়াল গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই কারণে অনেকের ধারণা যে, তাজমহলের প্রকৃত পরিচয় তাজের মাটিতেই প্রোথিত রয়েছে। প্রয়োজন শুধু একটা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের।

১৫। সাবেক আমলে উপরের তলার শিবলিঙ্গকে ঘিরে সোনা ও রত্নখচিত বহুমূল্য একটি রেলিং ছিল। শাহজাহান সেই বহুমূল্য রেলিং সরিয়ে বা আত্মসাৎ করে সেখানে শ্বেত পাথরের রেলিং বসিয়ে দেন। পুরানো রেলিংয়ের দুটো গর্ত আজও তাজের মেঝেতে বিদ্যমান। শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদারও সেই পুরানো রেলিংয়ের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন।

১৬। শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে তাজ-পরিসরের বাগানের নক্শাও নির্মাণ করেছেন কাশ্মীরের এক ব্যক্তি, নাম রণমল। কিন্তু প্রশ্ন হল তথাকথিত যে সব বিদেশী মুসলমান স্থপতিরা মূল তাজের নক্শা করল এবং তাজ নির্মাণ করল, তাদের বাদ দিয়ে হঠাৎ কেন একজন হিন্দুকে দিয়ে বাগান তৈরি করা হল?

১৭। বিগত ১৯৭৩ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কের প্র্যাট স্কুলের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শ্রী মারভিন মিলস আগ্রার তাজ পরীক্ষা করতে আসেন এবং তাজের উত্তরের দরজার কাঠের সামান্য একটু নমুনা সঙ্গে করে আমেরিকায় নিয়ে যান। আমেরিকার ব্রুকলীন কলেজের রেডিও কার্বন ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষ ডঃ ইভান উইলিয়ামস-এর তত্ত্বাবধানে ঐ কাঠের নমুনাটির ‘কার্বন-১৪’ পরীক্ষা করে তার প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা হয়। দেখা যায় যে, তা ১৩২০ থেকে ১৩৯৮ সালের মধ্যে তৈরি। অর্থাৎ শাহজাহানের সময় থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগের তৈরি।

তথ্য সূত্র, ড. রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারীর লেখা “মিথ্যার আবরণে দিল্লী আগ্রা ফতেপুর সিক্রি” বই থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *