করাচী শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে জেহাদী আক্রমণ!

দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে আমার অভ্যাসমত স্কুল থেকে এসে বিকালে ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার পর মঠাধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দজী মহারাজ আমাকে বল্লেন, রবি “তুই এক্ষুণি গিয়ে শ্রীশকে ডেকে নিয়ে আয়, করাচী থেকে মহারাজ এসেছেন তাঁর দুটো পাঞ্জাবী সেলাই করতে হবে। আমি সাইকেলে গিয়ে শ্রীশবাবুকে সামনে বসিয়ে মঠে ফিরলাম, শ্রীশবাবু মিশনের ভক্ত এবং মহারাজদের পাঞ্জাবী সেলাই করতেন। তিনি মাপ নিয়ে চলে গেলেন রাতভর পরিশ্রম করে দুটো পাঞ্জাবী তৈরী করে সকালে মঠে পৌঁছে দিলেন। পাঞ্জাবীগুলো সাদা কাপড়ের ছিল, পরদিন আমি মঠে গেলে স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দের আদেশ অনুসারে আমাদের পাড়ার ‘রঞ্জক সাবান” কোম্পানীর বাড়ী থেকে দুটো গেরুয়া রং করার সাবান এনে তাঁদের নির্দেশ অনুসারে পাঞ্জাবী দুটোকে গেরুয়া রং করে দিলাম। কার জন্য এই দুটো পাঞ্জাবী রং করা হলো জানেন? তিনি করাচী রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ পরবর্তীকালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার এক দিন আগে থেকেই অর্থাৎ ১৩ই আগষ্ট ১৯৪৭ থেকেই করাচীতে হিন্দু এবং শিখদের উপর মুসলমানদের অত্যাচার আরম্ভ হয়। মুসলমানরা করাচী রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ সময় করাচী দিল্লী বিমান চলাচল বন্ধ, ঢাকা করাচী বিমান চলতো তাই রঙ্গনাথানন্দজী এক কাপড়ে বিমান যোগে ঢাকা এসে রামকৃষ্ণ মিশনে উঠেছেন। এরপর প্রায় তিনমাস তিনি ঢাকা মঠে ছিলেন। প্রায়ই কোননা কোন ভক্তের বাড়ীতে বৈকালে তার ধর্মালোচনা সভা হতো, আমার কাজ ছিল ওনাকে রিক্সা করে নিয়ে যাওয়া এবং সভা শেষে মঠে পৌঁছে দেওয়া। যেদিন যার বাড়ীতে সভা হতো তাঁরাই যাতায়াতের রিক্সা ভাড়া দিয়ে দিতেন। শ্রী জুনারকর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাড়ীতেই অধিকাংশ দিন সভা হতো। আমার সৌভাগ্য যে এহেন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রায় তিন মাস একই রিক্সায় যাতায়াত করার সুযোগ পেয়েছি। এখানো রঙ্গনাথানন্দজীর লেখা পত্র আমার সংগ্রহশালায় আছে, করাচী মঠে থাকাকালে লালকৃষ্ণ আদবানী এমন কি পাক প্রেসিডেন্ট মঃ আলী জিন্নাও মিশনে এসে তাঁর বক্তৃতা শুনতেন। কথিত আছে স্বামী বিবেকানন্দের পর রামকৃষ্ণ মিশনে অতবড় বক্তা আর কেউ ছিলেন না। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে বেদান্ত প্রচারে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছেন। ঢাকা থাকাকালিন আমি জানতে পারি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দু নিধনের সময় করাচী মঠের গ্রন্থাগারের প্রায় ৬০ হাজার দুঃষ্প্রাপ্য বই পুড়িয়ে দেয় জেহাদী মুসলমান দুস্কৃতিরা। তার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির সংগ্রহে থাকা সিন্ধু সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছিল যা তারা রক্ষা কল্পে মিশনে জমা দিয়েছিলেন। এরপর করাচী মঠ বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায় তার সুদ থেকে ভরতুকি দিয়ে মিশন বইপত্র গুলি সস্তাদরে বিক্রি করে, এই লাইব্রেরীটা পোড়ানোর ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দের একটি লেখা প্রণিধান যোগ্য-

“তাহাদের (মুসলমানদের) মূলমন্ত্র” আল্লা এক এবং মহম্মদই এক মাত্র পয়গম্বর” যাহা কিছু ইহার বহির্ভূত সে সমস্ত কেবল খারাপই নহে, উপরন্তু সে সমস্তই তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করিতে হইবে। যে কোন পুরুষ বা নারী এই মতে সামান্য অবিশ্বাসী তাহাকেই নিমেষে হত্যা করিতে হইবে। যাহা কিছু এই উপাসনা পদ্ধতির বহির্ভূত তাহাকেই অবিলম্বে ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে, যে কোন গ্রন্থে অন্যরূপ মত প্রচার করা হইয়াছে সেগুলিকে দগ্ধ করিতে হইবে। প্রশান্ত মহাসাগর হইতে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ধরিয়া রক্তের বন্যা বহিয়া গিয়াছে ইহাই মুসলমান ধর্ম।”

-স্বামী বিবেকানন্দ Practical Vedanta

এবার আসা যাক কেন রঙ্গনাথানন্দজী বিতাড়িত হলেন এবং করাচী মঠ পোড়ানো হলো। তিনি ছিলেন দক্ষিণ ভারতের কেরালা প্রদেশের নামবুদ্রী ব্রাহ্মণ পরিবারভুক্ত। করাচী শহর এবং পাকিস্তানে সব শহর গুলিতে ছিল খাটা পায়খানা যার মলগুলি পরিষ্কার করে হিন্দু মেথররা বাইরে ফেলে দিত। এরা ছিল মাদ্রাজী তথা দক্ষিণ ভারতীয়। ঐ সময় হিন্দুহত্যা আরম্ভ হলে ঐ মেথররা টাকা তুলে দুটো জাহাজ ভাড়া করে করাচী থেকে মাদ্রাজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। পাক সরকার দেখলো স্বপরিবারে সব মেথর চলে গেলে মল ফেলবে কে? তখন বলপূর্বক জাহাজ দুটো পাক সরকার আটক করে রাখে এবং তাদের মাদ্রাজ যাত্রা বন্ধ করে দেয় এবং রটিয়ে দেওয়া হয় স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর পরামর্শে এই মেথররা পাকিস্তান ত্যাগ করছে ফল- স্বরূপ মঠ ধ্বংস এবং অগ্নিসংযোগ, ঐ সময় করাচী থেকে প্রচুর সিন্ধিরা বিমান যোগে ঢাকা এসে ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করে মিশনে উঠতো, তাছাড়া রাত্রে মঠে মহিলাদের থাকা নিষিদ্ধ বলে, অনেক সিন্ধি পরিবারকে আমি ঢাকার মিশনের ভক্তদের বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা করে দিই। ২/৩ দিন থাকার পর তারা ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে ভারতে ঢুকেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ বিগত যৌবনা নারী এবং প্রৌঢ়। অর্থাৎ যুবতীরা অপহৃতা হয়েছেন এবং যুবকরা নিহত হয়েছেন।

এই সব ইতিহাস হিন্দুরা কোথাও লিপিবদ্ধ করেনি বরং ইতিহাস বিকৃত করেছে অথবা মিথ্যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে ইতিহাস ধ্বংস করেছে। অন্নদাশঙ্কর রায় তার বই “যুক্ত বঙ্গের স্মৃতি” পৃ. ১১২ তে লিখেছেন-“একদিন কুমিল্লার প্রসিদ্ধ উকীল ও নেতা কামিনী কুমার দত্ত ময়মনসিং এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি হেসে বলেন, যা পড়েছো বা শুনছো সব অতিরঞ্জিত। নোয়াখালীতে খুন হয়েছে শ আড়াই (২৫০), ধর্ষণের কেস খুবই কম, জোর করে যাদের মুসলমান করা হয়েছিল তারা এক দিন কি দুদিন বাদে প্রায়শ্চিত্ত করে আবার হিন্দু হয়েছে মোল্লাদের কাছে এটা একটা নূতন অভিজ্ঞতা।”

নোয়াখালীতে হিন্দু নিধনের অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি প্রাক্তন বিচারপতি এডওয়ার্ড স্কিপার সিমসন (ICS) লিখেছেন। এক অঞ্চলে ৩০০রও বেশি এবং অন্য এক অঞ্চলে ৪০০রও বেশি নিরীহ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

এই মিথ্যাবাদী উকিল বাবু বলেছে, “একদিন বা দুইদিন বাদে হিন্দুরা আবার প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু হয়েছে। আমার প্রশ্ন এই গন্ডগোলের সময় কি প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব? একজন ব্রাহ্মণ নেয়াখালী থেকে তার ভাইকে একপত্র লেখেন ‘আমরা সব কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছি’। অভ্যাস বসত চিঠির প্রথমে তিনি শ্রীশ্রী হরি সহায় লেখেন। পোস্ট অফিসে সেই চিঠি গেলে মুসলমানরা শ্রীশ্রী হরি মুছে দেয় এবং লেখার জন্য প্রচন্ড মারধর করেন।

১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট একশনের উপর সরকার যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন তার রিপোর্টের সমস্ত কপি ডঃ বিধান রায় পুড়িয়ে দেন। ১৯৫০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী হিন্দু নিধনের শিকার হয়ে কলিকাতা আসার পর রোজ বৈকালে আমার মামা কেশব ঘোষের সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে যেতাম মামা ঐ পত্রিকার চিফ্ সাব এডিটার ছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা আমাকে ছেঁকে ধরতেন। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুনিধনের সংবাদ জানতে আমি অনেক বর্বরতার সংবাদ দিয়েছি তারা নোট করে নিয়েছে কিন্তু কোন সংবাদই ছাপা হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বিধান রায় আন অফিসিয়েল আদেশ জারি করেছে। পূঃ পাকিস্তানের কোন সংবাদ যাতে ছাপানো না হয়! এইত আমাদের চরিত্র। সত্য সেলুকাশ কি বিচিত্র এই দেশ। সত্য ইতিহাসও এদেশে লেখা চলবে না।

তথ্য সংগ্রহ –
পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ
লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ দত্ত
রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড় মঠ প্রকাশিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *