বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রমিক দিবস হলো বিশ্বকর্মা পূজার তিথি!

ছবি: বিশ্বকর্ম পূজা।

সনাতন শাস্ত্রমতে দৈবশক্তি হোক কিংবা মনুষ্য, সকল শ্রমজীবীদের শৈল্পিকতার আরাধ্য দৈবশক্তির আঁধার হলো দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।
অর্থাৎ সকল শ্রমজীবী মানুষ তথা শ্রমিক, শিল্পী, প্রকৌশলী ও কারিগরদের আরাধ্য দৈবশক্তি হলো বিশ্বকর্মা। যিনি শ্রমিক ও শ্রমের সমন্বয় ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট শৈল্পিক কর্ম দ্বারা, তাই তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রথম স্থপতি ও কারিগর নামেও আখ্যায়িত, এছাড়াও পৌরাণিক মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দেবশিল্পী, স্থপতি, কারিগর, নির্মাতা এবং যন্ত্রপাতি তথা বিশ্বশৈল্পিক সৃষ্টির দৈবশক্তি হিসেবেও পরিচিত।
মূলত কর্ম-কর্মের ফলে শিল্পের বিকাশই বিশ্বকর্মা পূজার মৌলিক তত্ত্ব। তাই বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যেদিন সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রমকে বিশ্বকর্মার চরণে অঞ্জলি মাধ্যমে সমর্পণ করে

বিশ্বকর্মার ধ্যান ও প্রনাম মন্ত্র, যথা:

“ওঁ দংশপালঃ মহাবীরঃ সুচিত্রঃ কর্মকারকঃ।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃকতঞ্চ বাসনামানো দণ্ডধৃক।।
ওঁ বিশ্বকর্মণে নমঃ।”

ধ্যান ও প্রনাম মন্ত্র অনুসারে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার যে চিত্র পাওয়া যায়- তাতে তিনি একাধারে মহাবীর ও দয়াদি অষ্টগুন যুক্ত । তিনি সৃষ্টির নির্মাতা ও ধাতা । তিনি মানদণ্ড ধারী মহাশিল্পী। আবার তিনি মহাযোদ্ধা।

পবিত্র ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দুটি ৮১ ও ৮২ নং সুক্তে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার স্তুতি বর্ণিত রয়েছে। পবিত্র ঋগ্বেদের অনুসারে তিনি সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ। তাঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদ সবদিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি।

বিশ্বকর্মা বর্ণনায় পবিত্র ঋগ্বেদে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহান স্থপতি যিনি আকাশ, পৃথিবী, সমুদ্র এবং জীবজাগতিক সকল শৈল্পিকতা নির্মাণকারী।

পবিত্র ঋগ্বেদে যিনি মুখ্যতঃ বিশ্বস্রষ্টা, পৌরাণিক শাস্ত্রে তাঁকে দেবশিল্পী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি “কর্তা শিল্প সহস্রাণাম” অর্থাৎ তিনি সহস্র শিল্পের অধিকর্তা। তিনি “দেবানাং কার্য্যসাধকঃ” অর্থাৎ দেবতাদের শিল্পের কার্য্য সাধক।

বৈদিক শাস্ত্রের অন্তর্গত আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদেও দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সৃষ্টকর্ম রয়েছে, স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মার রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক গ্রন্থটির নাম “বাস্তুশাস্ত্রম”। সুপরিকল্পিতভাবে গৃহনির্মাণ, মন্দির, গ্রাম, নগর, যন্ত্র প্রভৃতির পত্তনের নিয়মাবলি এবং বিধিনিষেধ তাঁর গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। এছাড়াও মৎস্যপুরাণের ২৪২ থেকে ২৪৭ অধ্যায়, অগ্নিপুরাণের ১০৪ থেকে ১০৬ অধ্যায়, গরুড়পুরাণের ৪৬ থেকে ৪৭ অধ্যায়, ভবিষ্যপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের তৃতীয় খণ্ড, বিভিন্ন আগম, শুক্রনীতিসারের চতুর্থ অধ্যায়, বৃহসংহিতা, গৃহ্যসূত্র, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতিতে বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা পাওয়া যায়।

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এ ব্রহ্মাণ্ডের যুগে যুগে অসংখ্য শৈল্পিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রমজীবীদের দেবতারুপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং অসংখ্য শৈল্পিক নিদর্শনের স্রষ্টা হয়েছেন, যেমন:

  • দেবরাজ ইন্দ্র, যম, বরুণ ও কুবেরের রাজমহল;
  • দেবতাদের ব্যবহৃত অস্ত্র ও রথ;
  • বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূল ও মহাশক্তিধর ধনুক পিনাক, দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র;
  • সূর্যদেবের রথ ও অশ্ব;
  • ত্রেতা যুগে রাবণের সোনার লঙ্কা;
  • দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী, পান্ডবদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী;
  • এছাড়াও বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ মতে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নকশাও স্বয়ং বিশ্বকর্মাই প্রস্তুত করেন।

তাই বিশ্বকর্মা হলেন শ্রমের দেবতা, শিল্পের দেবতা, শৈল্পিকতার দেবতা। শ্রমজীবীদের কঠোর শ্রমকে আরো মহিমান্বিত করতে মহাশক্তিধর কর্মঠ হস্তীকে তাঁর বাহনরুপে প্রকটিত করেছেন।
বিশ্বকর্মার চরণে শ্রমজীবীদের ভক্তি প্রণাম:

“ওঁ দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক,
বিশ্বকর্মন্নমস্তূভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদায়ক।”

লিখেছেন –
দেবাশিস সাহা
অধ্যক্ষ
আর্য সংস্কৃত কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *