
বাংলাদেশের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরোনো। বাংলার মাটিতে বাউল, ফকির, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, পালাগান, গাজীর গান, বসন্ত উৎসব—এসবের ভেতর দিয়েই আমাদের প্রাণের প্রকাশ ঘটেছে। ধর্ম, জীবন, প্রকৃতি—সবকিছুকে মিলিয়ে এখানে এক বিস্ময়কর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, একপাক্ষিকভাবে ওয়াজ মাহফিলের বিস্তার আমাদের এই বহুমাত্রিক সংস্কৃতির শিকড়ে আঘাত হানছে।
ষাট ও সত্তরের দশকে গ্রামবাংলায় মেলা মানেই গান, নাটক, পালাগান, কবিগান কিংবা জারি-সারি। মানুষ আনন্দ করত, আবার শিখতও। সেই মেলাতেই পাশে ধর্মীয় আচারও থাকত, কিন্তু কেউ কারও জায়গা কেড়ে নিত না। আশির দশক থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় ওয়াজ ধীরে ধীরে বিশাল আয়োজনে রূপ নিতে থাকে। নব্বইয়ের দশক এলে গ্রামীণ মেলা থেকে একে একে পালাগান, কবিগান, বসন্ত উৎসব হারিয়ে যেতে শুরু করে। ওয়াজ আয়োজন বেড়ে উঠল, কিন্তু গানের আসরকে “হারাম” বলে দমন করার প্রবণতা দেখা গেল। এই প্রবণতা সময়ের সঙ্গে এতটা বাড়ল যে, লোকসংস্কৃতিকে অশুদ্ধ বা নিষিদ্ধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া শুরু হলো।
এখন ২০০০ সালের পর থেকে যে চিত্র স্পষ্ট হয়েছে, তা আরও ভয়াবহ। একসময় যে গ্রামে বসন্তে রঙিন আবির উড়ত, ঢোল বাজত, গান হতো, এখন সেই গ্রামে বসন্ত উৎসবকে “বিদআত” বলে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। জারি-সারি গান, পালাগান কিংবা ভাটিয়ালি রাতভর চলত—আজ সেখানে ওয়াজ ছাড়া আর কিছু নেই। এভাবে ওয়াজের একচ্ছত্র আধিপত্য মানুষের আনন্দ-বেদনার গান, প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন আর হাজার বছরের লোকঐতিহ্যকে ক্রমশ মুছে দিচ্ছে।
ধর্মের কথা শোনানো ভুল নয়—ধর্ম আমাদের আত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু যখন ধর্মীয় আয়োজনকে ব্যবহার করে সংস্কৃতির ওপর দমননীতি চালানো হয়, তখন সেটা আর আধ্যাত্মিকতার জায়গায় থাকে না, বরং হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক দমনযন্ত্র। আজকের বাংলাদেশে সেই চিত্রই দেখা যাচ্ছে। ওয়াজ মাহফিল দিন দিন বিস্তার লাভ করছে, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ সংগীত ও উৎসবের জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রাণ কখনো একরঙা ছিল না। এখানে ধর্মও আছে, গানও আছে, উৎসবও আছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে ওয়াজের উগ্রতা আমাদের সেই বহুরঙা সংস্কৃতিকে ধূসর করে দিয়েছে। বসন্তের রঙ আজ যেন নিভে আসছে, পালাগানের সুর নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে, জারি-সারি গান শুধু ইতিহাসের পাতায় আটকে যাচ্ছে।
এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। কারণ, শুধু ওয়াজ দিয়ে একটি জাতির সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারে না। আমাদের দরকার সেই সহাবস্থান—যেখানে ধর্ম থাকবে, আবার গানও থাকবে; ওয়াজ হবে, আবার বসন্ত উৎসবও হবে। আমাদের পূর্বপুরুষ যে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন, তার প্রাণকে বাঁচাতে হলে এই সহাবস্থান ফিরিয়ে আনতে হবে।
লিখেছেন –
প্রফেসর চন্দন সরকার
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মী।