বাংলাদেশে হিন্দু নিধন এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যার ইতিহাস পর্ব-১

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ধর্মীয় নিধন (Ethnocide) এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যা (Cultural Genocide): এক পরিকল্পিত ইতিহাস -০১

বাংলাদেশে মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর দীর্ঘকাল ধরে চালানো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত হিন্দুরা ধর্মীয় নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, সামাজিক বঞ্চনা এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দুদের উপর ব্যাপক হিংসা, হত্যা, ধর্ষণ এবং সম্পত্তি দখল ঘটে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময় হিন্দুদের “অপদার্থ” এবং “দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক” হিসেবে দেখা হতো। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং সামাজিক নিপীড়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

হিন্দুদের জমি ও সম্পত্তি দখলের জন্য প্রণীত “শত্রু সম্পত্তি আইন” ছিল এই বৈষম্যের বড় হাতিয়ার। এই আইনের মাধ্যমে হাজার হাজার একর জমি, ব্যবসা ও বাড়িঘর মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ও প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। একই সঙ্গে হিন্দু মন্দির ভাঙচুর, পূজা-পার্বণে বাধা এবং নারীদের উপর সহিংসতা ক্রমশ বেড়ে ওঠে।

১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত দাঙ্গায় শত শত হিন্দু নিহত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। আনুমানিক ২০ থেকে ৩০ লক্ষ হিন্দু নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি হিন্দু ভারতে পালিয়ে যায়। হিন্দুদেরকে “ভারতীয় এজেন্ট” হিসেবে চিহ্নিত করে টার্গেটেড হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং ধর্মীয় নিধন চালানো হয়।

স্বাধীনতার পরও হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দল ধারাবাহিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে “অপদার্থ” ও “দেশদ্রোহী” আখ্যা দিয়ে হামলা, জমি দখল এবং মন্দির ধ্বংস অব্যাহত রাখে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে এসব নির্যাতন আরও বৃদ্ধি পায়।

২০০১–২০০৬ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময় হিন্দুদের উপর ভয়াবহ হামলা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর এবং জমি দখলের ঘটনা ঘটে। হাজার হাজার হিন্দু পরিবার তাদের বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০২১ সালে দুর্গাপূজা ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে হিন্দুদের উপর সংগঠিত হামলা ঘটে। মন্দির ভাঙচুর, বাড়িঘর লুটপাট, এবং হিন্দু নারীদের উপর সহিংসতা অব্যাহত থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় দেশে হিন্দুদের উপর ব্যাপক আক্রমণ হয়; বাড়িঘর, দোকান ও মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপি বারবার হিন্দুদের “ভারতীয় এজেন্ট” এবং “কাফের” হিসেবে চিহ্নিত করে সহিংসতা উসকে দেয়। রাষ্ট্রের পুলিশ ও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, বরং কখনো কখনো হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছে।

ক্রমাগত নির্যাতন ও সামাজিক বঞ্চনার কারণে হিন্দুরা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, বহু পরিবার দেশত্যাগ করেছে। ফলে জনসংখ্যাগত দিক থেকেও এক বিপুল পতন ঘটে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০%, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭–৮%।

ধর্ম পালনে বাধা, মন্দির ভাঙচুর, জোরপূর্বক ধর্মান্তরের চাপ এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব হ্রাস—সবকিছু মিলে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হারানোর পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে কয়েক দশক ধরে পরিকল্পিতভাবে চালানো এই নির্যাতন ও বিতাড়ন নিঃসন্দেহে একটি ধর্মীয় নিধন (ethnocide) এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যা (cultural genocide)-এর শামিল।

লিখেছেন –
প্রফেসর চন্দন সরকার
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *