
বাংলাদেশের পৃথক পৃথক স্থান থেকে চার হিন্দু ব্যাক্তির রহস্যজনক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সিলেট থেকে রণদির দাস(৬৫), মৌলভীবাজার থেকে ঝুমা রাণী দাস(২৬), চট্টগ্রাম থেকে মিঠুন দাস এবং ঝালকাঠি থেকে পলাশ সূত্রধরের(৩০) রহস্যজনক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
রণদির দাস
২২ সেপ্টেম্বর সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট জেলা নগরীর শাহপরাণ থানার দাসপাড়া এলাকায় নিজ ফার্মেসী থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ব্যবসায়ী রণদির দাসের (৬৫)মরদেহ। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি মানসিকভাবে কিছুটা অস্থির ছিলেন।
ঝুমা রাণী দাস
২২ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকেল ৩টার দিকে মৌলভীবাজার জেলা বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদীঘা গ্রামের স্বামীর বাড়ি থেকে ঝুমা রাণী দাসের (২৬) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
লাশের পাশে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। যাতে লেখা ছিল ‘প্রিয় স্বামী, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি নিজেই দায়ী। আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ। আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসি। আমার কলিজার টুকরা রাধিকাকে রেখে গেলাম তোমার কাছে। আমার বিশ্বাস তুমি রাধিকার মা, বাবা দুটোই হতে পারবে। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।—ইতি ঝুমা।’
ঝুমা রাণী বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদীঘা গ্রামের রূপক চন্দ্র দাসের স্ত্রী। তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। তার নাম রাধিকা (৫)।
জানা যায়, ঝুমা রাণী দাস তার মেয়ে রাধিকা (৫) ও স্বামী রূপক চন্দ্র দাসসহ নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। তার স্বামী রূপক চন্দ্র দাস ফ্রান্স প্রবাসী। তিন মাস পূর্বে ছুটিতে দেশে আসেন। সোমবার সকালে ঝুমার স্বামী, ভাশুর, শাশুড়ি ও মেয়ে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যান। অসুস্থ থাকায় ঝুমা রাণী দাস বাড়িতে থেকে যান। বিকেল ৩টার দিকে ঝুমা রাণী দাসের জা তার (ঝুমার) কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বসতঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে খোলেন। এসময় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ঝুমাকে দেখতে পেয়ে তিনি চিৎকার দেন। পরে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে ঝুমার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে বড়লেখা থানার এএসআই দেবল চন্দ্র সরকার ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেন।
পলাশ সূত্রধর
২৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে, ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ের ভাড়া বাসা থেকে ফ্যানের সঙ্গে গামছা দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পলাশ সূত্রধরের(৩০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত পলাশ সূত্রধর বরিশাল জেলা মুলাদী উপজেলার তেরচড় গ্রামের সুধীর সূত্রধরের ছেলে। থাকতেন ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ের ভাড়া বাসায়। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের টিস্যু পণ্যের বিক্রয় প্রতিনিধি পদে সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
মরদেহের পাশ থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘এই জীবন খুবই কঠিন। আমি আমার ব্যর্থতার যন্ত্রণায় এই সিদ্ধান্ত নিলাম। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, মেহেদি ভাই, এম কে ট্রেডার্স।’
স্বজনরা জানান, তিন মাস আগে ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নে বিয়ে করেন পলাশ। আগে থেকেই স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। এ কারণে চড়া সুদে ঋণও করেন। নতুন সংসার পরিচালনা ও পুরোনো ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করছেন। তবে সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে মরদেহ। প্রতিবেদন পেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
মিঠুন দাস
২৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম জেলা সীতাকুণ্ড উপজেলা পৌর সদরের মৌলভীপাড়ায় চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন মিঠুন দাস। পকেটে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে মিঠুনের পরিচয় নিশ্চিত হয় রেল পুলিশ।
মিঠুন দাস রাজশাহীর প্রেমানন্দ দাসের ছেলে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি মন্দির থেকে নামার সময় ফেসবুক লাইভে ছিলেন মিঠুন দাস। এমকে মিঠুন নামে আইডি থেকে তিনি বলছিলেন, ‘কোনোদিন ভাবি নাই আমি এ সিদ্ধান্ত নেব। এর আগে সিদ্ধান্ত নিলে এত বড় ক্ষতিটা হতো না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ডিসেম্বর মাস থেকে বিপত্তি কাটতেছে না। মা লক্ষ্মীও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি কোম্পানির তিন লাখ টাকার মতো হারিয়ে ফেলেছি। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।’
এছাড়ও মিঠুন দাস ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘না ভালো স্বামী হতে পারলাম, না ভালো সন্তান; না ভালো ভাই হতে পারলাম।’
মিঠুনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখা গেছে, তিনি জরুরি রোগীদের জন্য নিয়মিত রক্ত দিতেন। গত ৯ মে ১৮ বারের মতো রক্ত দেন। সেই রক্তের ব্যাগ হাতে একটি পোস্ট দিয়েছেন।
ফেসবুক লাইভে মিঠুন আরও বলছিলেন, ‘আমি জানি আমার পরিবারকে দেখার কেউ নেই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে আমি মা-বাবাকে কীভাবে দেখাব। আমি চলে যাচ্ছি। যারা আমার কাছে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন। আমি নিজের থেকে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না। সরকারের কাছে একটাই আবেদন, আমার পরিবারটাকে ঋণমুক্ত করে বাঁচাইয়া রাখিয়েন। না ভালো স্বামী হতে পারলাম, না ভালো সন্তান; না ভালো ভাই হতে পারলাম। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। বিউটিকে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিও।’
সীতাকুণ্ড রেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আশরাফ ছিদ্দিকী বলেন, ওই যুবকের লাশ উদ্ধারের পর তাঁর বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছে। আত্মহত্যার আগে মিঠুন দাস একটি মন্দির এলাকা থেকে ফেসবুকে লাইভ করেছেন। সেখানে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। সেটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সংসারের অভাব-অনটন ও কর্মস্থলে তিন লাখ টাকা চুরি যাওয়ার ঘটনার জেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সংসারের বিবাদও থাকতে পারে।