
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নির্যাতনের ইতিহাস, অত্যাচার-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ইতিহাস। এই যে অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে আমাদেরকে যুগে যুগে আন্দোলন করতে হয়েছে, অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। মোগলদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে, আমাদের স্বকীয় ঐতিহ্য, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলন করেছিলাম সশস্ত্রভাবে। পৃথিবীর সমগ্র অঞ্চলে আমরা দেখেছি যে উপনিবেশিক শক্তির কাছে দূর্বল জাতীয়সত্তাগুলো-জাতিগুলো-দেশগুলো পরাধীনতার শিকল পরতে বাধ্য হয়েছিলো। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শক্তি হিসাবে আমরাও বিদেশী ইনভেডরদের কাছে আমাদের স্বাধীনতা, স্বকীয় অস্তিত্ব হারিয়েছি। বৃটিশ গভর্ণমেন্ট ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম তার দখলে নিয়ে যায়। তার আগে নিজেদের অধিকার নিয়ে এ অঞ্চলে আমরা বসবাস করছিলাম। ১৮৬০ সালে বৃটিশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলের শাসনভার হাতে নিলেও ১৯০০ সালে প্রত্যক্ষভাবে হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০ বিধি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিপূর্ণভাবে তার দখলে নিয়ে যায়। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত আমরা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করছি। নিজের অধিকার নিজের জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে আমরা লড়াই করছি।
আমি একটু সংক্ষেপে ব্যাকগ্রাউন্ডটা টানছি এর কারণ আছে। আমি দেখেছি বা আমরা বুঝেছি যারা রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা করেন, যাদেরকে আমি আমার ভাষায় পলিটোক্র্যাট বলি, তারা চিটাগাং হিল ট্রাক্টসের বিষয়টা হয় বোঝেন না, অথবা বুঝেও বুঝতে চান না। কিছুক্ষণ আগে আমার পূর্ববর্তী বক্তা শ্রদ্ধেয় লুৎফর রহমান শাহজাহান সুষ্পষ্টভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার বিষয়ে তাঁর মতামত রেখেছেন। এই ধরনের অভিমত পোষনকারী কতজন বক্তা আমাদের পক্ষে পেয়েছি সেটা আমাদের জানার বিষয় আছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, যখন সংবিধান রচিত হতে যাচ্ছিলো, তখন তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত নেতা, জুম্ম জাতির কর্ণধার মানবেন্দ্র লারমাকে বিভিন্নভাবে পার্লামেন্টে বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। বাঙালি জাতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে যথাযথ সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে ১৯৭২ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হতে যাচ্ছিলো, যদি সেই সংসদের কার্যবিবরণীগুলো আমরা পড়ে দেখি যা এখনো ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি, আমার এ কথার প্রমাণ সেখানে আছে। আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মানবেন্দ্র লারমা যে বক্তব্য রেখেছিলেন, যে আওয়াজ তুলেছিলেন সমগ্র দেশবাসীর কাছে, সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে করজোড়ে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস না করে দেওয়ার জন্য যে আবেদন করেছিলেন- কাকুতি করেছিলেন সেগুলো ধুলিস্যাত করে দেওয়া হয়েছিলো। আমরা ৭১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি। কিন্তু যে চিন্তা চেতনা নিয়ে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছি -অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় সে দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার সেখানে সংরক্ষিত করা সম্ভব হয়নি। আমরা জানি যে উগ্র জাতীয়তাবাদের চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, আমাদের সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়নি। স্বয়ং স্পীকার পর্যন্ত বলেছিলেন, তৎকালীন নেতৃবৃন্দ যারা সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা মি: লারমাকে বলেছিলেন, মি: লারমা আপনার বাঙালি হতে লজ্জা কিসের?
আমাদের যে সাংবিধানিক অধিকার ছিলো যেটা বৃটিশ সরকার ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি দিয়ে করে দিয়েছিলো এবং যেটা ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ স্বীকৃতি দিয়েছে, পাকিস্তান হওয়ার পর সেই আইনটাকে পাকিস্তান সরকার কার্যকরী করেছিলো এবং পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ১৯৫৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক্সক্লুডেড এরিয়ার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিলো। পাকিস্তানের সেই সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবিধানিক মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখা হয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৬৩ সালে যখন পাকিস্তানের ২য় সংবিধান রচিত হয়, তখন সংবিধানের ২৪২ নং ধারা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়ে পার্বত্য জেলার বিশেষ অধিকারের মর্যাদা খর্ব করে দেওয়া হয়েছিলো। পাকিস্তান মুসলিম চিন্তা চেতনায় ইসলামিক চিন্তা চেতনায় পরিচালিত হয়েছিলো, পাকিস্তান সরকারগুলো তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে সাম্যবাদ, যে সমাজতন্ত্র, যে গণতন্ত্র, যে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের মূল শ্লোগান দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার, দেশ-জাতি পরিচালনার মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুদের, জাতিগুলোর অধিকার তারা অগ্রাহ্য করে আসছেন। এবং আমরা শেষে এমন দেখেছি যে এখানে সাইলেন্ট ইনভেশন শুরু হয়েছে। আমরা জন সংহতি সমিতির নেতৃত্বে, যে সশস্ত্র আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি, আমাদেরকে বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী, বৃহৎ জনগোষ্ঠী, জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো আমাদেরকে এটা করতে বাধ্য করেছে। আমাদের অধিকার যদি ৭২-এর সংবিধানে সংরক্ষিত হতো, আমাদের মৌলিক অধিকার যদি স্বীকৃতি দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দু’দশক ধরে লিপ্ত হতে হতো না। আজকে আমরা অনেক মা-বোনকে হারিয়েছি সে উপজাতি হোক, সে পাহাড়ি হোক, সে বাঙালি হোক। তাহলে দেখা যাচ্ছে সরকার সশস্ত্র উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন এ জিনিসটা সুষ্পষ্ট। এখন আমাদেরকে একটা চুক্তির মাধ্যমে সরকারের সাথে সমঝোতায় যেতে হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি চুক্তির মাধ্যমে শান্তির অন্বেষায় একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে চেয়েছে। আমরা যে আন্দোলন করেছি তা একটা নিছক অশান্তি সৃষ্টির জন্যে নয়। আমরা সশস্ত্র আন্দোলন করেছি শান্তির জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, অস্তিত্ব রক্ষার জনা, ব্যক্তিগত অধিকার-জাতিগত অধিকার-মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের এ আন্দোলন বাংলাদেশের সমগ্র আন্দোলনের অংশ, বাংলাদেশের বৃহৎ আন্দোলন থেকে এটা বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের দেশের সংবিধানে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে জনগোষ্ঠীগুলো আছে, যাদেরকে উপজাতি বলা হয়েছে, কেবল তাদের অধিকারকেই অস্বীকার করা হয়নি, সমগ্র দেশের ন্যাশনাল মাইনোরিটিজ অন্যান্য যারা আছেন তাদের অধিকারকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আজকে নতুন পরিবেশে নতুন পরিস্থিতিতে সরকার এবং বাংলাদেশের যে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো আছে, যে বুদ্ধিজীবীরা আছেন তাদের এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত। সুসংগঠিতভাবে এটা শুরু করা উচিত যাতে সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলো আছে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আছে তাদের ধর্ম, ধর্মের অধিকার এবং তাদের জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আজকে যদি আমরা সংবিধান দেখি, দেখি ধর্মের স্বাধীনতা, খর্ব করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে বলবো আমাদের দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ? যে দেশের সংবিধান শুধু একটি বিশেষ ধর্মের নেতৃত্ব দেয়, প্রতিনিধিত্ব করে, সেই দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বা ধর্মীয় সংখালঘুদের অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?
আজকে শুধু এটা নয়, বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষকেও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সিকি শতাব্দীকালের ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো বাংলার আপামর জনগণের মৌলিক অগ্রগতি কিছু হয় নাই। অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গরীব মেহনতি মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনি, তারা গরীব থেকে গরীবতর হচ্ছে, আর ধনীর সংখ্যা দু’থেকে দু’হাজার হতে যাচ্ছে। সুতরাং আজকে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য, এগিয়ে আসা দরকার। পূর্ববর্তী বক্তা শ্রদ্ধেয় লুৎফর রহমান শাহজাহান বলেছেন আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক শুধু নয়, সমগ্র বাংলাদেশভিত্তিক দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। আমি মনে করি আমাদের আন্দোলন কোন দিন বিচ্ছিন্ন ছিলো না, বাংলাদেশের আপামর জনগণের মৌলিক সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো না, আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে দূরে ছিলো না। আমাদের ইতিহাস আছে, ৬৯-এর গণআন্দোলনে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মানুষ যেমন শরীক হয়েছিলো, মাঠে নেমেছিলো, রাজপথে নেমেছিলো, তেমনি নেমেছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং পরবর্তীতে যে নেতৃত্ব এখানে ছিলো, তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে, মূল আন্দোলন থেকে কোনদিন বিচ্ছিন্ন হয়নি।
আজকে আমি কয়েকটি বিষয় সুবিবেচনার জন্য আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমরা শান্তিচুক্তি করেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে যে পরিস্থিতি ছিলো সে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে এটা আমরা বলতে পারি। কিন্তু খুব বেশী পরিবর্তন হয়েছে বা হবে এই জিনিসটা ধরে নিয়ে আমরা নিশ্চিত থাকবো তা হতে পারে না। আমরা শুধু আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করি নাই, সমগ্র বাঙালি জাতিকে বিশ্বাস করে আমরা চুক্তি করেছি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে জন সংহতি সমিতিকে বা মি: সন্তু লারমাকে দায়িত্ব নিতে দীর্ঘদিন সময় নিতে হয়েছে, চুক্তি মোতাবেক সংসদে আইনগুলো গৃহীত না হওয়ার জন্য। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে লংঙ্ঘন করে ১২ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০টি সংশোধনী করে, পরিবর্তন করে অর্থাৎ চুক্তি অমান্য করে ওখানে ৪টি বিল উত্থাপন করা হয়েছিলো। আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম এবং ১৮, ১৯, ২০ এই তিনদিন ঢাকায় বিশেষ বৈঠক হয়েছিলো। তখন সরকারী প্রতিনিধি দল আমাদেরকে কথা দিয়েছিলেন সবকিছু ঠিক রেখে বিলগুলো ঠিক করে আইনগুলো পাশ করবেন। অত্যন্ত বেদনাদায়ক, অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় যে সেই বিলগুলো ঠিকভাবে সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। গৃহীত হয়নি এবং মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন ক’রে, চুক্তি বিরোধী ধারা রেখে সেগুলো পরিবর্তন করা হয়েছিলো যার ৪টা বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
আজকে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলো এখনো ৫২৫টা যে সেনাছাউনী আছে ওখান থেকে মাত্র ২১টা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখনও সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পগুলো সেখানে কেনো রাখা হলো, কাদের স্বার্থে? শান্তিচুক্তির স্বার্থে যদি রাখা হয়, যদি বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্যে হয়, তাহলে আমাদের উচিৎ বিশ্বাস যেনো ভঙ্গ না হয় সেজন্য দ্রুত এগুলো প্রত্যাহার করা। আমি এখানে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, গত মাসের ২ তারিখে বাঘাইহাট বাজারে একটা বড় ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেখানে ৫০ জনের মতো লোক সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪ জনকে জন সংহতি সমিতির উদ্যোগে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে হয়েছে। কিন্তু কেনো? সামান্য একটা বিষয় যেটা সহজে মিটমাট করা যেতো তা করতে কেনো আজকে আমরা ব্যর্থ হলাম? এটা দুঃখজনক বিষয়।
কয়েকদিন আগে এক পরিচিত ব্রিগেড কমান্ডার-এর কাছে আমি জিনিসটা বলছিলাম আমি বলেছি এটা অনাকাঙ্খিত। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা দিতে রাজী আছি, কিন্তু সামরিক বাহিনী যাতে এ ধরণের তৎপরতা না নেয়। শান্তিচুক্তির স্বার্থে, শান্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে, এই ধরণের কাজ থেকে যেন বিরত থাকা হয় আমি সেই মর্মে উনাদের অনুরোধ করেছি। আমাদের ১৯ জন বন্দী ছিলো যখন শান্তিচুক্তি হচ্ছিলো, এখনো ১১ জন বন্দী জেলখানা থেকে মুক্তি পাননি। অথচ তাদের মুক্তির কথা চুক্তিতে আছে। মৌখিকভাবে আমরা বার বার বলেছি, লিখিতভাবে বলেছি। কি অসুবিধা আছে? সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার মতো কোন যুক্তি আছে ব’লে আমি মনে করি না। জাতীয় কোন পার্টিই এখানে বাধা সৃষ্টি করছে না, বলছেনা যে জন সংহতি সমিতির ১৯ জন কর্মীকে মুক্তি দেওয়া যাবেনা। কেন এত মাস চলে যাচ্ছে তবু তারা মুক্তি পাচ্ছে না? ২৭ তারিখে সরকার মহাজলসা করতে যাচ্ছে রাঙামাটিতে। আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে গ্র্যান্ড রিসেপশন, গ্র্যান্ড ফাংশন হচ্ছে। কিন্তু তার আগে যদি আমাদের এই ১১জন কর্মী মুক্তি না পায় তাহলে শান্তিচুক্তির স্বার্থকতা কোথায় আছে এই জিজ্ঞাসা আজকে আপনাদের কাছে। আজকে যে বন্ধুরা জেলে আছে তাদেরকে রেখে আমরা কিভাবে শপথ গ্রহণ করতে পারি? এর সুবিবেচনার ভার আমি আপনাদের কাছে দিতে চাই।
আর একটা জিনিস আপনাদের কাছে তুলে ধরা দরকার। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে শান্তিচুক্তির বিরোধীতা করেছিলো। এখন তারা নীরব। সেরকম সক্রিয়তা আমরা দেখছি না। আশাকরি তারা জিনিসটাকে পজিটিভলী চিন্তা করছেন। কিন্তু আমাদের পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে, পার্বত্য স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের দাবী উত্থাপন করে, আজকে শান্তি বিঘ্নিত করার সকল প্রকার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। প্রশাসনের একপক্ষ তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য। দুর্ভাগ্য যে আজকে দেশের কিছু রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন জন সংহতি সমিতিকে চরমভাবে বিরোধীতা করে। আজকে সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং বাংলাদেশের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অবস্থাকে বিচার করে শান্তিচুক্তি করতে আমরা এগিয়ে এসেছি।
শান্তি আমাদের দরকার ছিলো, সেজন্য শান্তিচুক্তি করেছি। দেশে-বিদেশে সবদিক থেকে আজকে শান্তিচুক্তির স্বীকৃতি মিলছে। এই শান্তিচুক্তির জন্য পুরষ্কার মিলেছে। কিন্তু পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে বা নামে আজকে জন সংহতি সমিতিকে ধ্বংস করার জন্য কিছু যুবক যে কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যদি আপনারা দেশবাসী ও সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন তাহলে সমস্যা অন্যদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি বিভিন্ন ফোরামে বলেছি যে আজকে জন সংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের ঘাড়ে তারা তাদের বন্দুকের নল তাক করেছে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবী আদায়ের জন্যে। আমি দেখেছি সর্বহারা পার্টি শ্রেণী সংগ্রাম করার জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের মধ্যে গিয়ে আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন। এমন শ্রেণী সংগ্রাম উনারা করেছিলেন জনগণ তাদেরকে সেখান থেকে উৎখাত করেছিলো। রাজনীতির মূল্যায়নে ভুল থাকার কারণে, রণনীতিগত বিশ্লেষণে ভুলের কারণে সর্বহারা পার্টি এক বিশেষ জনগোষ্ঠিকে নিয়ে ওখানে আন্দোলন করেছিলো, রণনীতি সঠিক ছিলোনা বলে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
আজকে বাংলাদেশেও কিছু বুদ্ধিজীবী দুর্ভাগ্যজনকভাবে শান্তিচুক্তি বিরোধী পাহাড়ি যুবকদের সমর্থন করছেন। এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আবেদন রাখতে চাই, এই ব্যাপারে আপনাদের দায়িত্ব আছে। আজকের এই ফোরামে আমি বলতে চাই যে এই শান্তিচুক্তি হত্যা করা হলে যে ক্ষতি হবে সেই ক্ষতির দায়ভার শুধু সেই পাহাড়ি যুবকদের বইতে হবে না। সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও এটার দায়ভার বইতে হবে, কৈফিয়ত দিতে হবে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষদের কাছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের কাছে তাদের কৈফিয়ত দিতে হবে যারা ঢাকায় বসে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছেন, সর্বপ্রকার মদদ দিচ্ছেন। আপনাদের সুবিবেচনার জন্য আমি এই বক্তব্য দিলাম।
আমার বক্তব্য আমি এই বলে শেষ করছি যে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যা করা প্রয়োজন তা করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা দীর্ঘ যুগের পর যুগ ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণ আদায় আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছি। বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যে সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলো আছে তাদের আন্দোলনের জন্য আমরা সক্রিয়ভাবে জাতীয়ভিত্তিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের আন্দোলন বাংলাদেশের যে আন্দোলন তার মূল স্রোতধারা থেকে কোনদিন বিচ্ছিন্ন ছিলোনা। আমরা কোনদিন বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা করি নাই। আজকে আমি জন সংহতি সমিতির পক্ষে এই জিনিসটা অকপটে বলতে চাই, আমরা দেশেরই মানুষ। দেশের স্বার্থ আমাদের স্বার্থ। দেশের সন্তান হয়ে, সুযোগ্য সন্তান হিসাবে, আমরা দায়িত্ব পালন করতে চাই।
রূপায়ন দেওয়ান
সিনিয়র সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।