আফগানিস্তান ত্যাগ করা হিন্দু ও শিখদের দেশে ফেরার আহ্বান তালেবান মন্ত্রীর।

ছবি: তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।

আফগানিস্তানে মুসলিম তথা তালেবান জঙ্গিদের হাতে অত্যাচারীত হয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়া অমুসলিম বা হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি কথা দিয়েছেন, এই হিন্দু ও শিখরা আফগানিস্তানে ফিরলে তাদের পুরোনো সম্পত্তি ফিরে পেতে এবং পুরনো ব্যবসাপাতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকার তাদের সাহায্য করবে।

সম্প্রতি তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফরের সময় দিল্লির আফগান দূতাবাসে ১৩ জন হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীর (যারা সবাই আফগানিস্তান থেকে চলে এসেছেন) একটি প্রতিনিধিদল দেখা করলে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন।

তবে আফগান নাগরিকরা মনে করছেন, এখনও তাদের দেশে ফেরার মতো নিরাপদ পরিবেশ আদৌ তৈরি হয়নি, তবে তালেবান সরকার যদি সে দেশে অবশিষ্ট কয়েকটি হিন্দু মন্দির ও শিখ গুরদোয়ারার রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্ব নেয় তবে বিদেশে বসবাস করা আফগান নাগরিকরা আশ্বস্ত হবে।

এই মুহুর্তে পুরো আফগানিস্তানে মাত্র ৫০ জনের মতো হিন্দু ও শিখ বসবাস করছেন বলে ওই প্রতিনিধিদলের হিসাব। যারা সবাই বিভিন্ন শিখ গুরদোয়ারা ও হিন্দু মন্দিরগুলোতে কোনোক্রমে পূজাপাঠ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ওই সম্পত্তিগুলোর যাতে আর কোনও ক্ষতি না হয় সেই চেষ্টা করছেন।

তাদের মধ্যে ১৫ জনের মতো রয়েছেন কাবুলে, ১০-১২ রয়েছেন জালালাবাদে। এছাড়াও গজনী, হিরাটসহ দেশের আরও নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন আরও কয়েকজন হিন্দু ও শিখ।

দিল্লিতে এই প্রতিনিধিদল কে আমির খান মুত্তাকি বলেন, ‘আফগানিস্তান আপনাদের দেশ, আপনাদের জন্মভূমি। আপনারা যখন খুশি নিজেদের দেশে ফিরে আসুন, যেসব ব্যবসাপাতি বা দোকানপাট ফেলে গেছেন সেগুলো আবার চালু করুন!’

‘আফগান হিন্দু শিখ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র প্রেসিডেন্ট হরভজন সিং বলছেন, ‘জীবনের দাম সবার আগে। নিজেদের জন্মভূমিকে কে না ভালবাসে, কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর আমরা খুন হয়ে গেলে আমাদের পরিবারকে কে দেখবে বলুন?’

হরভজন সিং আরও বলেন, এই মুহূর্তে কাবুলে কারতে পারওয়ান আর গুরু হর রাই সাহিব – এই দুটো গুরদোয়ারাই শুধু টিমটিম করে চালু আছে। জালালাবাদে আছে মাত্র একটি, গুরু নানক দরবার। আর গোটা দেশে হিন্দু মন্দির টিকে আছে মাত্র একটাই— কাবুলের আশামাঈ মন্দির।

দিল্লিতে যে হিন্দু-শিখ প্রতিনিধিদল আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন আফগান মাইনরিটিজ কাউন্সিলের সদস্য গুলজিত সিং।

গুলজিত সিং জানান, তালেবান মন্ত্রী যাই বলুন তারা মনে করেন না আফগানিস্তানে তাদের ফেরার মতো পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হয়েছে। ‘তবে আমরা চাইছি তালেবান সরকার যাতে আমাদের ধর্মীয় স্থানগুলো রক্ষা করার সুযোগ দেয়। সে জন্য আমরা মন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছি আমাদের ৩০ জনকে মালটিপল এন্ট্রি/এক্সিট ভিসা দেওয়া হোক– যাতে আমরা সেখানে গিয়ে গুরদোয়ারা বা মন্দিরগুলোর দেখাশোনা করে আবার এখানে ফিরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগ দিতে পারি।’

তবে তালেবান সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী যে প্রকাশ্যে আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ও ব্যবসাপাতি ফিরে পেতে সাহায্য করার কথা বলছেন – সেটাকেও অনেক পর্যবেক্ষক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মুত্তাকি দিল্লির দূতাবাসে যে কক্ষে হিন্দু ও শিখ প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন সেখানে তার মাথার ওপরই ছিল বামিয়ান উপত্যকায় বুদ্ধের দুটি মূর্তির ছবি– যেটি ২০০১ সালে তখনকার তালেবান সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

সেই বামিয়ান বুদ্ধের ছবি দূতাবাসে টাঙিয়ে রেখে তালেবান ২.০ সম্ভবত এই বার্তাই দিতে চেয়েছে যে তারা এখন দেশের ধর্মী‍য় সংখ্যালঘুদের অধিকারকেও মর্যাদা দেয়।

আফগান অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ কবীর তানেজা মনে করেন, ‘চার বছরের ওপর হয়ে গেলো তালেবান কাবুলের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এখনেও তারা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার স্বীকৃতি তেমন পায়নি বললেই চলে। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া বলেই মুত্তাকি দিল্লি সফরে এসেছিলেন এবং এখানে এসে তিনি যথারীতি এমন বার্তাই দিতে চাইবেন যা মোদি সরকারকে খুশি করবে।’

মুত্তাকির সফরের দ্বিতীয় দিনেই দিল্লিতে তিনি যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, তাতে কোনেও নারী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর সে ঘটনা যথারীতি তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে দুই দিন পর আর একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাতে আবার নারী সাংবাদিকরাও আমন্ত্রিত ছিলেন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার আহ্বান জানানোও তালেবান সরকারের একই রকম একটি ‘ইমেজ মেরামতে’র চেষ্টা বলেই মনে করেন কবীর তানেজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *