পরমেশ্বরের ত্রিমূর্তি। – ড. শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী।

ছবি: পরমেশ্বরের ত্রিমূর্তি।

এক পরমেশ্বর বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হলেও তিনি মূলত এক।তিনিই ব্রহ্মা হয়ে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু হয়ে পালন করেন এবং তিনিই মহেশ্বর শিবরূপে বিনাশ করেন। অথচ পরমেশ্বরের অনন্তরূপী বৈচিত্র্যময় বিষয়টি আমরা আমাদের ক্ষুদ্রজ্ঞানে উপলব্ধি করতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এ ত্রিমূর্তি একই পরমেশ্বরের ত্রিরূপ। বিষয়টি বেদে যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি পুরাণাদি শাস্ত্রেও বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় মৈত্রায়নী সংহিতার অন্তর্ভুক্ত মৈত্রায়নী আরণ্যকে ঋষি কুৎস্যায়ন-দৃষ্ট মন্ত্রসমূহকে ‘কৌৎস্যায়নী স্তুতি’ বলা হয়। সেই স্তুতিতে সাকার নিরাকার নির্বিশেষে পরমেশ্বরের এক এবং অদ্বিতীয় সত্ত্বার পরিচয় দেয়া হয়েছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের অভেদত্ব বর্ণিত হয়েছে :

ত্বং ব্রহ্মা ত্বং চ বৈ বিষ্ণুস্ত্বং রুদ্রস্ত্বং প্রজাপতিঃ।
ত্বমগ্নির্বরুণো বায়ুস্ত্বমিদ্ৰস্ত্বং নিশাকরঃ।।
ত্বং মনুস্ত্বং সমস্ত্বং পৃথিবী ত্বং বিশ্বং ত্বমথাচ্যুতঃ।
স্বার্থে স্বাভাবিকেঽর্থে চ বহুধা সংস্থিতিস্ত্বয়ি ৷৷
বিশ্বেশ্বর নমস্তুভ্যং বিশ্বাত্মা বিশ্বকর্মকৃৎ।
বিশ্বভুগ্বিশ্বমায়ুস্ত্বং বিশ্বক্রীড়ারতিপ্রভুঃ।।
নমঃ শান্তাত্মনে তুভ্যং নমো গুহ্যতমায় চ।
অচিন্ত্যায়াপ্রমেয়ায় অনাদিনিধনায় চেতি ৷৷

(মৈত্রায়নী আরণ্যক: ৫.১-৪)

“হে বিশ্বেশ্বর, তুমি ব্রহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি রুদ্র। তুমিই প্রজাপতি, তুমিই অগ্নি, তুমিই বরুণ ও বায়ু। তুমিই ইন্দ্র ও চন্দ্র। তুমিই অন্ন, তুমিই যম, তুমিই পৃথিবী, তুমিই চরাচর বিশ্ব। তুমি আকাশ ও অচ্যুত। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—এই পুরুষার্থ চতুষ্টয় এবং স্বভাব অনুযায়ী লোকের যে নিষ্ঠা দেখা যায় তৎসমুদয় বহুধা তোমাতে সংস্থিত। তুমিই সব, তোমাকে নমস্কার করি। তুমি শান্তাত্মা কূটস্থ স্বরূপ। তুমিই গুহ্যতম, অচিন্ত্য, অপ্রমেয়, অনাদি ও স্বয়ং প্রকাশিত। তোমাকে নমস্কার।”

সাকার নিরাকার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বরূপে তিনি যে একজনই এ বিষয়টি যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের ত্রয়োদশ অনুবাকের একটি শ্রুতিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে।

তস্য শিখায়া মধ্যে পরমাত্মা ব্যবস্থিতঃ।
স ব্রহ্ম স শিব স হরিঃ সোহক্ষরঃ পরম স্বরাট।।

(তৈত্তিরীয় আরণ্যক:১০.১৩.১২)

” জীবের হৃদয়ে পরমাত্মা অবস্থিত। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শিব, তিনিই হরি, তিনিই ইন্দ্র। তিনি অক্ষর, স্বয়মদীপ্ত রাজা, তিনিই জীবের শ্রেষ্ঠ গতি।”

প্রতিটি পুরাণে আবার সে একত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের প্রথম স্কন্ধেই বলা হয়েছে, পরমেশ্বর এক হলেও এই তিনটি গুণের প্রভাবে বিশ্বের সৃষ্টি -স্থিতি-লয়ের জন্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপ ধারণ করেন। অর্থাৎ ব্রহ্মা,বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের মধ্যে কোন ভেদ নেই।

সত্ত্বং রজস্তম ইতি প্রকৃতেৰ্গুণাস্তৈ-
র্যুক্তঃ পরঃ পুরুষ এক ইহাস্য ধত্তে।
স্থিত্যাদয়ে হরিবিরিঞ্চিহরেতি সংজ্ঞাঃ
শ্রেয়াংসি তত্র খলু সত্ত্বতনোনৃর্ণাং স্যুঃ।।

(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ: ১.২.২৩)

“প্রকৃতির তিনটি গুণ-সত্ত্ব, রজ এবং তম। পরমেশ্বর এক হলেও এই তিনটি গুণের প্রভাবে বিশ্বের সৃষ্টি -স্থিতি-লয়ের জন্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপ ধারণ করেন। বিশুদ্ধ সত্ত্বমূর্তি ভগবান শ্রীহরি থেকেই মানুষের পরম মঙ্গল হয়ে থাকে।”

ব্রহ্মা,বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের এ অভেদ তত্ত্বটি শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :

শ্রীভগবানুবাচ।
অহং ব্রহ্মা চ শৰ্বশ্চ জগতঃ কারণং পরম্।
আত্মেশ্বর উপদ্রষ্টা স্বয়ংদৃগবিশেষণঃ৷৷
আত্মমায়াং সমাবিশ্য সোঽহং গুণময়ীং দ্বিজ।
সৃজন্ রক্ষন্ হরন্ বিশ্বং দধ্ৰে সংজ্ঞাং ক্ৰিয়োচিতাম্॥
তস্মিন্ ব্রহ্মণ্যদ্বিতীয়ে কেবলে পরমাত্মনি।
ব্রহ্মরুদ্রৌ চ ভূতানি ভেদেনাজ্ঞোঽনুপশ্যতি ॥
যথা পুমান্ন সাঙ্গেষু শিরঃপাণ্যাদিষু ক্বচিৎ।
পারক্যবুদ্ধিং কুরুতে এবং ভূতেষু মৎপরঃ৷৷
ত্রয়াণামেকভাবানাং যো ন পশ্যতি বৈ ভিদাম্।
সর্বভূতাত্মনাং ব্রহ্মন্ স শান্তিমধিগচ্ছতি ॥

(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:৪.৭.৫০-৫৪)

“শ্রীভগবান বললেন -যে আমি জগতের পরম কারণ স্বরূপ, সকলের আত্মা, ঈশ্বর, সাক্ষীস্বরূপ তথা স্বপ্রকাশ এবং উপাধিশূন্য সেই আমিই ব্রহ্মা এবং মহাদেব।
হে বিপ্র ! নিজের ত্রিগুণাত্মিকা মায়াকে আশ্রয় করে আমিই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং সংহার করে থাকি এবং সেই সেই কর্মের অনুরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শংকর—এ তিন নাম ধারণ করেছি।
এইরূপ যে ভেদরহিত বিশুদ্ধ পরব্রহ্মস্বরূপ আমি, অজ্ঞ ব্যক্তিরাই তার মধ্যে ভেদ আরোপ করে ব্রহ্মা, রুদ্র এবং অন্যান্য প্রাণী হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দর্শন করে থাকে৷
যেমন কোনো মানুষই নিজের মস্তক, হস্ত প্রভৃতি বিভিন্ন অঙ্গে ‘এটি আমার থেকে ভিন্ন’—এইরূপ ভেদবুদ্ধি করে না, সেইরকমই আমার ভক্ত কোনো প্রাণীকেই আমার থেকে ভিন্নরূপে দর্শন করে না॥
হে প্ৰজাপতি দক্ষ! ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আমরা এই তিনজন স্বরূপত এক এবং আমরাই সকল প্রাণীস্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি আমাদের এই তিন জনের মধ্যে কোনো ভেদদর্শন করে না সেই শান্তি লাভ করে৷”

বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান সৃষ্টি , পালন ও সংহার করার জন্য ব্রহ্মা ,বিষ্ণু ও শিব নামে অভিব্যক্ত হন।

সৃষ্টিস্থিত্যন্তকরণাদ্ ব্রহ্মবিষ্ণুশিবাত্মিকাম্ ।
স সংজ্ঞাং যাতি ভগবান্ এক এব জনাৰ্দ্দনঃ ॥
স্রষ্টা সৃজতি চাত্মানং বিষ্ণুঃ পাল্যশ্চ পাতি চ ৷
উপসংহ্রিয়তে চান্তে সংহৰ্ত্তা চ স্বয়ং প্রভুঃ ॥
পৃথিব্যাপস্তথা তেজো বায়ুরাকাশমেব চ।
সর্বেন্দ্রিয়ান্তঃকরণং পুরুষাখ্যং হি যজ্জগৎ ॥
স এব সর্বভূতেশো বিশ্বরূপো যতোঽব্যয়ঃ ।
সর্গাদিকং ততোঽস্যৈব ভূতস্থমুপকারকম্ ॥
স এব স্থজ্যঃ স চ সর্গকর্তা
স এব পাত্যত্তি চ পাল্যতে চ।
ব্রহ্মাদ্যবস্থাভিরশেষমূর্তি-
বিষ্ণুর্বরিষ্ঠো বরদো বরেণ্যঃ ॥

(বিষ্ণুপুরাণ:১.২.৬২-৬৬)

“ভগবান্ জনার্দনই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব—এইরূপ সংজ্ঞা প্রাপ্ত হন। প্রভু বিষ্ণু স্রষ্টা হয়েও আপনাকে সৃজন করেন, পালক ও পাল্য হয়ে আপনাকেই পালন করেন এবং শেষে সংহর্তা ও উপসংহাৰ্য্য হয়ে স্বয়ংই উপসংহৃত হন । যেহেতু পৃথিবী, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ, সর্বেন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ ইত্যাদিরূপ জগৎসমস্তই পুরুষ আখ্যায় অভিহিত। যখন ঐ অব্যয় হরিই সর্বভূতেশ এবং বিশ্বরূপ, তখন ভূতস্থ সর্গ্যাদি তাঁরই উপকারক বা বিভূতির বিস্তারহেতু। তিনিই সৃজ্য, তিনিই সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই পালন ও ভক্ষণ করছেন। তিনিই প্রতিপালিত হচ্ছেন এবং তিনিই ব্রহ্মাদি অবস্থায় অশেষ মূর্ত্তিধারী, অতএব বিষ্ণুই বরিষ্ঠ, বরদ এবং বরেণ্য।”

বিষ্ণুপুরাণে অক্রূরের উক্তিতেই সুস্পষ্ট, নিরাকার পরম ব্রহ্মই জগতের আদি কারণ। সেই পরম ব্রহ্ম অবিকারী, জন্মরহিত, নাম রূপহীন, কল্পনার অতীত, বাক্য দ্বারা অনির্দেশ্য। কিন্তু সেই সর্বব্যাপী অব্যক্ত পরমেশ্বরকে কল্পনা ব্যাতীত অন্য কোন উপায়ে স্তুতি করা যায় না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এই ত্রিদেব সেই অব্যক্ত নিরাকার ব্রহ্মেরই কল্পিত নাম ও রূপ। কেননা ব্রহ্ম অবিকারী, নিরাকার, নাম-রূপ-উপাধি বিবর্জিত।

প্রসীদ সর্ব সর্বাত্মান্ ক্ষরাক্ষরময়েশ্বর।
ব্রহ্মবিষ্ণুশিবাদ্যাভিঃ কল্পনাভিরুদীরিতঃ।।
অনাখ্যেয়স্বরূপাত্মন্ অনাখ্যেয়প্রয়োজন
অনাখ্যেয়াভিধানং ত্বাং নতোঽস্মি পরমেশ্বর।
ন যত্র নাথ বিদ্যন্তে নামজাত্যাদিকল্পনাঃ।
তদব্রহ্ম পরমং নিত্যমবিকারী ভবানজ।
ন কল্পনামৃতেঽর্থস্য সর্বস্যাধিগমো যতঃ।
ততঃ কৃষ্ণাচ্যুতানন্ত-বিষ্ণুসংজ্ঞাভিরাড্যতে।।

(বিষ্ণুপুরাণ:৫.১৮.৫১-৫৪)

“হে সর্ব! হে সর্ব্বাত্মন! হে ক্ষরাক্ষরময়! হে ঈশ্বর! তুমি প্রসন্ন হও। হে ভগবান! ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবাদি রূপ কল্পনা করে তোমার স্তব করছি, তুমি প্রসন্ন হও।
হে অব্যক্ত পরমেশ্বর! তোমাকে নাম ও বাক্য দ্বারা নির্দেশ করা যায় না। হে প্রভু! তোমাকে নমস্কার।
হে নাথ, হে অজ (জন্মরহিত)! যাঁর নাম রূপ ও জাতির কল্পনা করা যায় না, তুমিই সেই নিত্য অবিকারী পরম ব্রহ্ম।
হে প্রভু! যেহেতু কল্পনা ব্যাতীত সমস্তকিছুরই জ্ঞান সম্ভব নয়, তাই তোমাকে শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণু, অচ্যুত প্রভৃতি নামে কল্পনা করে জীব উপাসনা করে থাকে।”

শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তরভাগে মহর্ষি উপমন্যু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে মহেশ্বর শিবের অষ্টমূর্তির কথা বর্ণনা করেন। মহর্ষি উপমন্যু বলেন, পরমাত্মা রূপ শিব সকল এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া সর্বত্র আছেন, তাই তাঁর নাম ‘সর্ব’। সর্বভূতের অণুতে পরমাণুতে তিনি বিরাজমান। তিনিই নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম, আবার তিনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিব। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই পালন করেন এবং তিনিই লয় করেন।

স শিবঃ সর্বমেবেদং স্বকীয়াভিশ্চ মূর্তিভিঃ
অধিতিষ্ঠত্যমেয়াত্মা যৎ তৎ সর্বস্ততঃ স্মৃতঃ।।
ব্রহ্মা বিষ্ণুস্তথা রুদ্রো মহেশানঃ সদাশিবঃ।
মূর্তয়স্তস্য বিজ্ঞেয়া যাভির্বিশ্বমিদং ততম্।।

(শিবপুরাণ: বায়বীয়সংহিতা, উত্তরভাগ,৪.২-৩)

“পরমাত্মা শিব স্বকীয় মূর্ত্তিসমূহ দ্বারা সকল কিছুতেই অধিষ্ঠান করে আছেন বলে তিনি ‘সর্ব’ নামে কীৰ্ত্তিত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিবসহ বিবিধ মূর্তিতে প্রকাশিত।”

মৎস্যপুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় তা বর্ণিত হয়েছে:

গুণেভ্যঃ ক্ষোভমাণভ্যস্ত্রয়ো দেবা বিজজ্ঞিরে।
একা মুর্তিস্ত্রয়ো ভাগা ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ।।

(মৎস্যপুরাণ:৩.১৬)

“প্রকৃতির গুণত্রয় ক্ষুদ্ধ হলে, তা হতে দেবত্রয় আবির্ভূত হন।একই মূর্তিই তিনভাগে বিভক্ত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এ ত্রিমূর্তিতে প্রকাশিত হন।”

গরুড় পুরাণের পূর্ব্বখণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে ত্রিদেব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, স্বয়ং শ্রীহরি ব্রহ্মা হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে জগৎ পালন করেন এবং রুদ্ররূপে কল্পান্তে জগৎ সংহার করেন।

অণ্ডস্যান্তর্জগৎ সর্বং সদেবাসুরমানুষম্।
স্রষ্টা সৃজতি চাত্মানং বিষ্ণুঃ পাল্যঞ্চ পাতি চ ৷।
উপসংহ্রিয়তে চান্তে সংহর্তা চ স্বয়ং হরিঃ ।।
ব্রহ্মা ভূত্বাঽজদ্বিষ্ণুর্জগৎ পাতি হরিঃ স্বয়ম্।
রুদ্ররূপী চ কল্পান্তে জগৎ সংহরতে প্রভুঃ।।

(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ৪.১০-১২)

” সৃষ্টির অণ্ডমধ্যে দেব, আসুর, মানুষসহ সমবেত চরাচর জগৎ উৎপন্ন হল। এইরূপে স্রষ্টা নিজেকেই সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং প্রলয়কালে হরি স্বয়ং রুদ্ররূপী হয়ে সংহারও করেন । হরি স্বয়ং ব্রহ্মা হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে জগৎ পালন করেন এবং রুদ্ররূপে কল্পান্তে জগৎ সংহার করেন।”

গরুড় পুরাণের পূর্ব্বখণ্ডের ত্রয়োবিংশ অধ্যায়ে ভগবান হরি বলেন:

মায়া চ শুদ্ধবিদ্যা চ ঈশ্বরশ্চ সদাশিবঃ।
শক্তিঃ শিবশ্চতান্ জ্ঞাত্বা মুক্তোজ্ঞানী শিবো ভবেৎ।
যঃ শিবঃ স হরিব্রর্হ্মা সোঽহং ব্রহ্মাস্মি মুক্তিতঃ।।

(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ২৩.৩৪)

“মায়া, শুদ্ধবিদ্যা, ঈশ্বর, সদাশিব, শক্তি, ও শিবের পূজা করবে। যিনি শিব, তিনিই হরি, তিনিই ব্রহ্মা এবং আমিও সেই হরিহরব্রহ্মাত্মক ব্রহ্মস্বরূপ এই প্রকার চিন্তা করবে। যে ব্যক্তি এ সকল জানে সে মুক্ত জ্ঞানী এবং শিবস্বরূপ হয়।”

কালিকা পুরাণের দ্বাদশ অধ্যায়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর ত্রিমূর্তির ত্রিদেব যে এক তা সবিস্তারে বলা হয়েছে:

ততো ব্রহ্মশরীরন্তু ত্রিধা চক্রে মহেশ্বরঃ ।
প্রধানেচ্ছাবশাচ্ছম্ভো ত্রিগুণত্রিগুণীকৃতম্ ॥
তদূর্দ্ধভাগঃ সঞ্জাতশ্চতুর্বক্ত্রশ্চতুর্ভুজঃ ।
পদ্মকেশরগৌরাঙ্গ-কায়ো ব্রাহ্মো মহেশ্বর ॥
তন্মধ্যভাগো নীলাঙ্গ একবক্ত্রশ্চতুর্ভুজঃ ।
শঙ্খচক্রগদাপদ্মপাণিঃ কায়ঃ সবৈষ্ণবঃ ॥
অভবত্তদধোভাগঃ পঞ্চবক্ত্রশ্চতুর্ভুজঃ ।
স্ফটিকাভ্রসমঃ শুক্লঃ সকায়শ্চন্দ্রশেখর।।
ইতস্ততো ব্রহ্মকায়ে সৃষ্টিশক্তিং ন্যযোজয়ৎ।
স্বয়মেবাভবৎ স্রষ্টা ব্রহ্মরূপেণ লোকভৃৎ ॥
স্থিতিশক্তিং নিজাং মায়াং প্রকৃত্যাখ্যাং ন্যযোজয়ৎ।
মহেশো বৈষ্ণবে কায়ে জ্ঞানশক্তিং নিজাং তথা ৷৷
স্থিতিকর্তাভবদ্বিষ্ণুরহমেব মহেশ্বরঃ ।
সৰ্বশক্তিনিয়োগেন সদা তদ্রূপতা মম।
অন্তশক্তিং তথা কায়ে শাম্ভবে স ন্যযোজয়ৎ ॥
অন্তকর্তাভবচ্ছম্ভুঃ স এব পরমেশ্বরঃ।
ততস্ত্রিষু শরীরেয়ু স্বয়মের প্রকাশতে।।
জ্ঞানরূপং পরং জ্যোতি-রনাদিৰ্ভগবান্ প্রভুঃ ।
সৃষ্টিস্থিত্যন্তকরনাদেক এব মহেশ্বরঃ।
ব্রহ্মা বিষ্ণুঃ শিবশ্চেতি সংজ্ঞামাপ পৃথক্ পৃথক্।।

(কালিকা পুরাণ:১২.২৯-৩৭)

“হে মহেশ্বর! অনন্তর ব্রহ্মা প্রকৃতির ইচ্ছাক্রমে ত্রিগুণময় নিজ শরীরকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন; হে শম্ভো! এই বিভক্ত শরীরত্রয় ত্রিগুণময় হল।
হে মহেশ্বর ! সেই অখণ্ড শরীরের ঊর্দ্ধভাগ চতুৰ্ম্মুখ চতুর্ভুজ কমল-কেশর সন্নিভ আরক্তবর্ণ বিরিঞ্চিশরীরে পরিণত হল।
মধ্যভাগে একমুখ, শ্যামবর্ণ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ বিষ্ণুশরীর।
এবং অধোভাগে পঞ্চানন চতুভুজ স্ফটিকবৎ শুক্লবর্ণ শিবদেহ হল।
অনন্তর, জগৎপালক পরমেশ্বর, ব্রহ্মার শরীরে সৃষ্টিশক্তি নিয়োজিত করে আপনিই ব্রহ্মরূপে সৃষ্টিকর্তা হলেন।
হে মহেশ্বর ! তিনি বিষ্ণুশরীরে স্থিতি শক্তি নিজ মায়া প্রকৃতি ও নিজ জ্ঞানশক্তি নিয়োজিত করলেন।
হে মহেশ্বর ! এইরূপে পরমেশ্বর মদ্রূপে স্থিতিকর্তা হলেন। আমাতে সৰ্বশক্তি নিয়োজিত করাতে আমি সর্বদা তৎস্বরূপে বিরাজমান।
তখন পরমেশ্বর, শম্ভুশরীরে প্রলয়কারিণী শক্তি নিযোজিত করলেন; সেই পরমেশ্বরই শম্ভুরূপে প্রলয়কৰ্ত্তা হলেন।
জ্যোতির্ময় জ্ঞানস্বরূপ সেই অনাদি এক পরমেশ্বরই সৃষ্টি, স্থিতি এবং ধ্বংস কার্যের জন্য তিন শরীরে বিরাজমান হয়ে ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও শিব এ পৃথক পৃথক সংজ্ঞা লাভ করেন।”

বরাহ মহাপুরাণের রুদ্রগীতাতেও ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও শিব এ ত্রিদেবের একত্ব বর্ণিত হয়েছে। সুবিস্তারে বলা হয়েছে, যিনি বিষ্ণু , তিনিই ব্রহ্মা , যিনি ব্রহ্মা তিনিই শিব । যারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবকে স্বতন্ত্র মনে করে তিনজনের মধ্যে ভেদ কল্পনা করেন, তারা দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন পাপাত্মা। তাদের মুক্তি তো লাভ হয় না, বরং চরমে তারা নিতান্ত দুর্গতি লাভ করে।

যো বিষ্ণুঃ স স্বয়ং ব্রহ্মা যো ব্রহ্মাসৌ মহেশ্বরঃ।।
বেদত্রয়ে চ যজ্ঞেহস্মিন্ পণ্ডিতেষ্বেয নিশ্চয়ঃ।
যো ভেদং কুরুতেহস্মাকং ত্রয়াণাং দ্বিজসত্তমঃ।
স পাপকারী দুষ্টাত্মা দুর্গতিং সমবাপ্নুয়াৎ।।

(বরাহ পুরাণ: রুদ্রগীতা, ৭০.২৬-২৭)

“যিনিই বিষ্ণু, তিনিই ব্রহ্মা, যিনিই ব্রহ্মা তিনিই মহেশ্বর। কি বেদত্রয়, কি যজ্ঞ, কি পণ্ডিতগণ, সকলেই এইরূপ নিশ্চয় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
দ্বিজবর! যিনি আমাদের তিনজনের মধ্যে ভেদ কল্পনা করেন, তিনিই পাপাত্মা, তিনিই দুষ্টবুদ্ধি এবং চরমে তাঁর নিতান্ত দুর্গতি লাভ হয়।”

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব একই পরমেশ্বরের ত্রিমূর্তি। এই ত্রিমূর্তি অভেদ ; তাঁরা একে তিন আবার তিনে এক৷ একই সত্তার সৃজনশক্তি, পালনশক্তি ও লয়শক্তি। তাই বেদসহ অধিকাংশ পুরাণে এ তিন দেবতা, একই পরমেশ্বরের ত্রিধা প্রকাশ রূপে বর্ণিত।

লিখেছেন –
ড. শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *