
১৯২১ সালে মালাবারে ঘটা যাওয়া হিন্দু গণহত্যার ওপর “বিনায়ক দামোদর সাভারকরের” মারাঠা ভাষায় লেখা উপন্যাস “মোপলা অর্থাৎ আমার তাতে কী?” উপন্যাস টি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন “মলয় পাতলা”।
বাংলা ভাষায় উপন্যাস টি প্রথম প্রকাশ হচ্ছে এই শারদীয়া দুর্গাপূজা ১৪৩২ (সেপ্টেম্বর,২০২৫) এ কলকাতা থেকে। প্রকাশনা: এভেনেল প্রেস(সংস্কৃত কলেজের বিপরীতে, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা)।
লেখক বিনায়ক দামোদর সাভারকর মনে করেন, মালাবারে মোপলাদের উৎপাতকালে সংঘটিত ভয়াবহ ঘটনাবলিকে না অতিশয়িত করে, না গোপন রেখে, বরং যেরূপে তাহা ঘটিয়াছিল, ঠিক সেইরূপে তাহার বিবরণ প্রত্যেক হিন্দুর কর্ণে পৌঁছাইয়া দেওয়া এবং তাহাদের হৃদয়ে এই অনিষ্টকর কার্যকলাপের ছাপ অঙ্কিত করা-ইহা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর। এই অভিপ্রায়েই বর্তমান কাহিনীর রচনা সম্পন্ন করেছেন।
উপন্যাসে উল্লিখিত নাম ও গ্রামের পরিচয় কাল্পনিক, তথাপি এখানে উপস্থাপিত ঘটনাবলির বিবরণে বাস্তব পরিস্থিতির যথার্থ প্রতিফলনই প্রতিভাত হইয়াছে। এই বর্ণনায় মপল্লাদের উৎপাতকালে সংঘটিত ভয়াবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহকে অতিরঞ্জিত করিবার চেষ্টা মোটেই করা হয় নাই।
শুধুমাত্র নানান ও বিচ্ছিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনাবলিকে এক সুনিবিড় কাহিনীর সূত্রে গাঁথিবার নিমিত্তে নাম, গ্রাম, কাল ও সময়ে যতটুকু সংক্ষেপণ বা পরিবর্ধন প্রয়োজন ছিল, কেবল ততটুকুই করা হইয়াছে। তথাপি, এই উৎপাতের উদ্দেশ্য, পটভূমি, কার্যধারা কিংবা ঘটনাপ্রবাহের সংগতিপূর্ণ ধারা ও সারমর্মের ঐতিহাসিক রূপে সামান্যতম বিকৃতিও যেন না ঘটে-ইহা নিশ্চিত করিবার জন্য যথোচিত সতর্কতা অবলম্বন করা হইয়াছে।
মোপলা বিদ্রোহকে ঘিরে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে মতভেদ বিরাজমান। একদল গবেষকের মতে, এটি মূলত মালাবারের জমিদার বা ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে ভূমিহীন কৃষকপ্রজাদের বিদ্রোহ ছিল। তাঁদের যুক্তি, এ আন্দোলনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক শোষণের প্রতিবাদ। ইতিহাস আংশিকভাবে এই যুক্তিকে মান্যতা দিলেও, এ বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় উগ্রতা এবং অমুসলিমদের উপর সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞকে উপেক্ষা করা যায় না। নিছক কৃষক আন্দোলন বা সামাজিক বিদ্রোহের গণ্ডি অতিক্রম করে এটি প্রকৃতপক্ষে অমুসলিম-বিরোধী ইসলামি জিহাদের রূপ ধারণ করেছিল। অতএব বলা যায়, মোপলা বিদ্রোহ একদিকে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিবাদে প্রজাদের বিক্ষোভ হিসেবে দেখা যেতে পারে, অন্যদিকে তাতে নিহিত ছিল উগ্র ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক রক্তক্ষয়ী প্রতিচ্ছবি, যা পরবর্তীকালে ইতিহাসের অমোঘ সত্যে পরিণত হয়েছে।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর মোপলা নামক উপন্যাসে তথাকথিত মোপলা বিদ্রোহে অন্তর্নিহিত উগ্র ইসলামিক ধর্মযুদ্ধের প্রকৃতি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তার প্রমাণ সমকালীন পত্র-পত্রিকাতেও বিদ্যমান।
১৯২১ সালের মোপলা দাঙ্গার ইতিহাস শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতিহাস কখনো প্রতিশোধের প্রেরণা জাগায় না; বরং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সত্যকে স্বীকার করাই আমাদের কর্তব্য। কারণ সেই স্বীকৃতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কতার বোধ জাগ্রত করে।
খিলাফত আন্দোলনের আড়ালে সংঘটিত মোপলা বিদ্রোহে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টি পরবর্তীকালে ডক্টর বি. আর. আম্বেদকর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ দেশের সমকালীন বহু নেতৃবৃন্দ স্বীকার করেছিলেন।
ডক্টর বি. আর. আম্বেদকর মন্তব্য করেছেন, “মালাবারের মোপলারা হিন্দুদের ওপর যে রক্ত-হিম করা অত্যাচার চালাত তা অবর্ণনীয়। সারা দক্ষিণ ভারতে সমস্ত মতাবলম্বী হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র সন্ত্রাসের ঢেউ, যার গভীরতা আরও বেড়ে গেল যখন কিছু খিলাফৎ নেতা এমন-ই বিপথগামী হয়ে গেলেন যে, তারা ধর্মের স্বার্থে মোপলারা যে সাহসিকতাপূর্ণ লড়াই চালাচ্ছিল তাকে অভিনন্দন জানালেন।”
যে কেউ অবশ্যই বলবেন, হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের জন্য এরকম মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু এই ঐক্য রক্ষায় গান্ধীজি এতটাই আবিষ্ট ছিলেন যে, মোপলাদের কাজকে হালকা করে দেখা বা খিলাফৎদের এ ব্যাপারে অভিনন্দন জানানোকে তিনি সহজভাবেই নিয়েছেন। মোপলাদের তিনি বলেছেন ধর্মভীরু; তারা যা ধর্ম বলে জেনেছে তার জন্যই লড়াই করছে, যে পদ্ধতিকে তারা ধর্মীয় মনে করছে, সেই পদ্ধতিতে।
মোপলাদের অত্যাচার সম্পর্কে মুসলমানদের নীরবতা প্রসঙ্গে গান্ধীজি বলেছেন: “হিন্দুদের এমন সাহস ও বিশ্বাস থাকতে হবে যে, এরকম ধীয় উন্মাদনা সত্ত্বেও তারা তাদের ধর্ম রক্ষা করতে পারবে। মোপলাদের উন্মাদনা সম্পর্কে মুসলমানদের মৌখিক অস্বীকৃতি বন্ধুত্বের কোনও পরীক্ষাই নয়। জোর করে ধর্মান্তরকরণ ও লুঠপাট করে মোগলারা যেমন আচরণ করেছে, সেজন্য মুসলমানদের লজ্জা ও বিনয়ের সঙ্গে তা স্মরণ ও অনুভব করা উচিত। হিন্দুদের এমন নীরবে অথচ কার্যকরভাবে কাজ করা উচিত যাতে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মোন্মাদদের পক্ষেও এমন কাজ করা সম্ভব না হয়। আমার বিশ্বাস, হিন্দুরা একযোগে মোপলা উন্মাদনাকে সমমানসিকতার স্থিরতা নিয়ে গ্রহণ করেছে এবং সংস্কৃতি সম্পন্ন মুসলমানরা নবির শিক্ষাকে মোপলারা বিকৃত করায় আন্তরিকভাবে দুঃখবোধ করছে।’
উপন্যাসের বাংলা ভাষায় অনুবাদক মলয় পাতাল বলেন, আমার জীবনের প্রথম গ্রন্থ আত্মবিস্মৃত বাঙালি ও বীর সাভারকর রচনার সময় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের একাধিক গ্রন্থ ও রচনা পাঠ করার সুযোগ হয়েছিল। সেই সূত্রেই মোপলা উপন্যাসটির সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটে। মূলত মারাঠি ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি পরবর্তীকালে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। আমি উভয় ভাষাতেই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করেছি। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে বেদবিদ্যা গবেষণা সংস্থান ও হিন্দি সাহিত্য সদন কর্তৃক প্রকাশিত সাভারকর মোপলা মুঝে উসসে ক্যা, প্রভাত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সাভারকর সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড)প্রভৃতি গ্রন্থের সহায়তা গ্রহণ করেছি। উপর্যুক্ত প্রকাশনাগুলির প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তি প্রেস প্রকাশিত মালাবার ও আর্য সমাজ, সমকালীন সংবাদপত্র এবং মোপলা বিদ্রোহ সম্পর্কিত নানা গ্রন্থ পাঠের সুযোগও আমার হয়েছে। এ কারণে আমি বিশ্বাস করি, সাভারকরের মোপলা উপন্যাসের এই অনুবাদে পাঠকরা এক নতুনত্ব খুঁজে পাবে ন। মূল উপন্যাসের যথাযথ স্বরূপ অক্ষুন্ন বজায় রেখে কিছু শব্দ বান্ধব অতিরিক্ত রূপে প্রয়োজনীয় মনে করে যুক্ত করা হয়েছে।
মলয় পাতলা আরও বলেন, বীর সাভারকরের মোপলা উপন্যাসের অনুবাদের উদ্দেশ্য কেবল হিন্দু নির্যাতনের বিভীষিকা উদ্ঘাটন নয়; এর পাশাপাশি তিনি হিন্দু সমাজের অনৈক্যের অন্যতম মূল কারণ-জাতিভেদ-প্রথাকেও এই গ্রন্থে গভীরভাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এই গ্রন্থটি যদি পাঠকের কাছে কেবল মনোরঞ্জনের উপকরণ কিংবা সাভারকরের প্রতি অনুরাগের কারণে গ্রহণযোগ্য না হয়ে, জাতিভেদপ্রথা এবং ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে সাভারকরের চিন্তাচেতনার মর্ম আত্মস্থ করার উপলক্ষ হয়ে ওঠে, তবে মনে করবো আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।

মলয় পাতলা ইতিহাস বিষয়ে ঐতিহ্যময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ., এম.এ., এম.ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণারত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিষয়বস্তুর প্রতি প্রধান আকর্ষণ হলেও ভারতীয় রাজনীতি ও ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসেন।। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের কার্যনির্বাহী সমিতিতে দীর্ঘ চার বছর (২০১৮-২০২২)সদস্য রূপে আসীন ছিলেন। ইতিপূর্ব ‘আত্মবিস্মৃত বাঙালির বীরসাভারকর’ নামক একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।