
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে সাধারণত কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে শুধু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। অনেকে তাঁকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্তই মনে করেন না। কিন্তু সমকালীন বিপ্লবীদের স্মৃতিকথা, ব্রিটিশ সরকারের গোপন নথি ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়-এই ধারণা আংশিক এবং অসম্পূর্ণ।
বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ
বাঙালি বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার তাঁর স্মৃতিচারণায় হেডগেওয়ারকে অভিহিত করেছিলেন “বিপ্লবী আন্দোলনের এক উজ্জ্বলতম নাম” হিসেবে। তিনি লিখেছিলেন-
“১৮৯৭-৯৮ সালে চাপেকর ভাইদের সময়ে মহারাষ্ট্রীয় এবং বাঙালী বিপ্লবীদের যে যোগাযোগ ছিল, ডাঃ হেডগেওয়ার তা পুনর্জীবিত করার জন্য সতত সক্রিয় ছিলেন। … এই দুই প্রদেশের বিপ্লবীদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডাক্তারজীই ছিলেন মূল কেন্দ্র বা মাধ্যম বিশেষ।”(ভূপতি মজুমদার, স্বস্তিকা, ডা: হেডগেওয়ার স্মৃতি সংকলন, ১৯৬২)
এমনকি অবিস্মরণীয় বাঘাযতীনের সঙ্গেও তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। সংবাদবাহক হিসেবে ভূপতি মজুমদার দু’বার গোপন বার্তা নিয়ে হেডগেওয়ারের কাছে যান (১৯১৪)। বিপ্লবী ষড়যন্ত্রের নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন।
হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় ভূমিকা
১৯১৫ সালে বিদেশ থেকে অস্ত্র আনার চেষ্টা চলে, যা ইতিহাসে ‘হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এ সময় বোম্বাই থেকে বাটাভিয়ায় এক গোপন টেলিগ্রাম পাঠানোর দায়িত্ব ভূপতি মজুমদারকে দেওয়া হয়। সেই মিশনের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন হেডগেওয়ার। ভূপতি মজুমদার লিখেছেন-
“আমার উপর এই ভার অর্পিত হয় এবং এইজন্য আমাকে ডাঃ হেডগেওয়ারের সহিত যোগাযোগ সাধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। … আমরা দুইজন ডাক্তারজীর নির্দেশ মতো মারাঠীর ছদ্মবেশে বোম্বাই গমন করি।”
পুলিশ তাদের খুঁজে বেড়ালেও মারাঠী ছদ্মবেশে থাকার কারণে তাঁরা ধরা পড়েননি।
ব্রিটিশ সরকারের ‘Book 1914’
ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স অফিস ১৯১৪ সালে যে বিশেষ তালিকা প্রকাশ করেছিল-“Political Criminals of India”,তাতে হেডগেওয়ারের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখানে তাঁর শারীরিক গঠন, অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যোগসূত্র এবং অস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতা পর্যন্ত লিপিবদ্ধ ছিল। এর অর্থ, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিপজ্জনক বিপ্লবী হিসেবেই দেখত।
(G.V. Ketkar, Ranjhunkar; “P.C. Khankhoje yaancha charitra”, p.12)
সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সম্পর্ক
অনুশীলন সমিতির আরেক বিপ্লবী ক্ষিরোদ কুমার দত্ত উল্লেখ করেছেন-১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু যখন আপোসবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন, তাঁর প্রতিনিধি ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী মধ্যপ্রদেশে গিয়ে হেডগেওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হেডগেওয়ার জানিয়েছিলেন, তাঁর ষাট হাজার স্বেচ্ছাসেবক আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে প্রস্তুত।
(ক্ষিরোদ কুমার দত্ত, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অনুশীলন সমিতি, পৃ. ১২৭-২৮)
বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রয়াস
হেডগেওয়ার শুধু গোপন সংবাদ আদানপ্রদানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি মধ্যপ্রদেশে “নরেন্দ্র মণ্ডল” নামে সাংস্কৃতিক আড্ডা গড়ে তোলেন, যা আসলে ছিল রাজনৈতিক বৈঠকের আড়াল। তরুণদের শারীরিক-মানসিক দীক্ষা দিতে তৈরি করেন ব্যায়ামকেন্দ্র ও পাঠাগার। তাঁদের হাতে তুলে দেন মাজ্জিনি, জোয়ান অব আর্ক, শিবাজী, সাভারকর ও বাংলার বিপ্লবীদের জীবনকাহিনি। উদ্দেশ্য ছিল এমন এক দল গড়ে তোলা, যারা প্রথম ধাক্কাতেই ভেঙে পড়বে না। ফলস্বরূপ, প্রায় ১৫০ জন শৃঙ্খলাবদ্ধ বিপ্লবী গড়ে ওঠে, যারা অস্ত্র প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিল।
(Balaji Huddar, “The RSS and Netaji”; The Illustrated Weekly of India, 7-13 October 1979, p.23)
বিপ্লবী প্রতুল চন্দ্র গাঙ্গুলী লিখেছিলেন—
“১৯১২-১৩ সালে নলিনীকিশোর গুহ মহাশয়ের প্রভাবে কয়েকজন মহারাষ্ট্রীয় যুবক অনুশীলন-সমিতির সভ্য হন। তাঁদের মধ্যে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সরল, সৎ, নিষ্ঠাবান, আন্তরিক কর্মী বলে সকলের আকর্ষণ করেছিলেন। ইনি ছিলেন নাগপুর অঞ্চলের লোক। পরবর্তীকালে এরই কর্মশক্তির ফলে এবং নেতৃত্বে সুপ্রসিদ্ধ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক দল গঠিত হয়। তিনিই হন এর গুরুজী।”(বিপ্লবীর জীবন দর্শন)
এছাড়া ১৯১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ আন্দোলন-এও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারের সিদ্ধান্তে যখন কলেজের ডিগ্রির স্বীকৃতি বাতিল হতে যাচ্ছিল, আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে শুরু করে নাগপুর পর্যন্ত জনসমাবেশ সংগঠিত হয়। প্রবল জনমতের চাপে ব্রিটিশ সরকার শেষমেশ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
(হিতবাদ, 12 January 1916, p. 7)
ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার শুধু RSS প্রতিষ্ঠাতা নন, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অজ্ঞাতসাধক বিপ্লবী। অনুশীলন সমিতি, বাঘাযতীন, হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র, সুভাষচন্দ্র বসুর আন্দোলন-সব ক্ষেত্রেই তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাঁর জীবন প্রবাহকে যদি কেবল একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ করা হয়, তবে ভারতীয় বিপ্লবী ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আড়ালে থেকে যাবে।
ভূপতি মজুমদারের ভাষায়-
“ভারতের আন্দোলনের পটভূমিকায় যে কটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র আমার দৃষ্টিতে পড়িয়াছে, ডাঃ হেডগেওয়ার তাহার মধ্যে একটি উজ্জ্বলতম নাম।”
লিখেছেন – সৌমক পোদ্দার