
‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা কলকাতা কুখ্যাত দাঙ্গার ডাক দিয়েছিল মুসলিম লিগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ। বলেছিল- “আমাদের হাতে পিস্তল আছে, তা ব্যবহার করতে জানি।” বাংলার মুসলিম লীগের সদস্য নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন- “There are a hundred and one ways in which we can create difficulties, specially when we are not restricted to non-violence. The Muslim population of Bengal know very well what “Direct Action” would mean and so we need not bother to give them any lead.”(আজাদ, মর্নিং নিউজ, ১১/৮/৪৬) শুরু হয় কাফেরদের উপর অত্যাচার। নরমেধ যজ্ঞ।
একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় যেখানে দেখা যায়- “অসি হস্তে জিন্নার ছবি। লেখা-কাফেরগণ হিন্দুরা তোদের দিন ঘনিয়ে এসেছে”। বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ লিখেছেন- “ট্রাক বোঝাই লিগ সমর্থক, তারা ছোরা, লাঠি ও সড়কি আস্ফালন করছে, পাকিস্তানের সমর্থনে স্লোগান দিচ্ছে। মনে হল, একটু আগে মসজিদের সামনে যে ট্রাকটি দেখেছিলাম সেটিই বুঝি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে উত্তর কলকাতার দিকে গেল। আমি বিবেকানন্দ রোডে পৌছানোর আগেই এরকম আরও দু’একটা ট্রাক মুসলিম লিগের স্লোগান দিয়ে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় মনে করলাম যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক সফল করার জন্য মুসলিম লিগের স্বেচ্ছাসেবকরা সারা কলকাতা ও শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়ছেন”।(হস্তান্তর)। রাস্তা রঞ্জিত হল রক্তে।
এই কাফের হত্যায় কতজন মারা গেল? কারা মরলো!- জিডি বিড়লার একটি চিঠি থেকে জানা যায়- “মধ্যম অনুমানের অনুসারে, প্রায় ৬,০০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং সমপরিমাণ আহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারে। এমন কিছু হিসাব আছে যেগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা সম্ভবত ১৫,০০০ পর্যন্ত হতে পারে… আমি ১৯২৬ সালের দাঙ্গা দেখেছি, যা অত্যন্ত গুরুতর ছিল। কিন্তু বর্তমান দাঙ্গার কোনো তুলনা ভারতে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। নির্মমতা ও ক্রোধকে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই মুক্তভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছিল। মুসলিম মনোভাব অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।
“ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে” ছিল সেই প্রারম্ভবিন্দু। যদি স্যার নাজিমউদ্দিনের সাক্ষাৎকারকে মুসলিম লীগে মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে ধরা যায়, যার একটি কপি আমি এখানে সংযুক্ত করছি, তবে মনে হয় সহিংসতার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। স্যার নাজিমউদ্দিনের সাক্ষাৎকার মুসলিমদের জন্য স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে তাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে। জানা যায়, দাঙ্গা শুরু হওয়ার আগের রাতে, বাংলার সরকারী মোটর লরিগুলি মুসলিম লীগ সমর্থিত এলাকা জুড়ে ঘুরে ঘুরে জনসমাগ্রীর দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল”(২২ আগস্ট ১৯৪৬)।
কারা আহত নিহত হয়েছিল? মৌলানা আজাদের লেখা থেকে জানা যায়- ‘তিনি বলেছিলেন, যদিও শুক্রবারে হতাহতের মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু ছিলেন, তার পর থেকে মুসলমানদের হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে'(Note on interview with Moulana Azad, 19.8.46)। কেন? বিধর্মীদের আক্রমণে সন্ত্রস্ত হিন্দুরাও তখন অস্ত্র ধারণ করেছে নিজ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। ২৪ আগস্ট ১৯৪৬ তারিখের এক সামরিক প্রতিবেদনে, ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর কলকাতার দাঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবরণ প্রদান করে। সেখানে সুহরাবর্দীকে ‘গুন্ডাদের রাজা’ বলা হয়েছে। লেখা আছে – “হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে আমি বলব এটি অন্তত ২–৩ হাজারের মধ্যে হতে পারে। উত্তর কলকাতায় সব জায়গায় মরদেহ পড়ে ছিল নদীতে, খালপথে, গলি-চৌরাস্তায়, আসলে সর্বত্রই। লুট করা এবং পোড়ানো দোকানের সংখ্যা প্রায় ২-৩ হাজারের মধ্যে হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নিহতের সংখ্যা উভয় পক্ষেরই সমান, অথবা যদি কিছু বেশি হয়, তবে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে বেশি। তবে আর্থিক ক্ষতি হিন্দুদের মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে”
অর্থাৎ কি বুঝলেন? বিধর্মী আক্রমণের বিরোধী শক্তি হিসাবে হিন্দু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। তবে প্রথম আক্রমণটা হিন্দুদের তরফে হয়নি স্পষ্ট। সহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরী করতে গিয়ে তারাও বাধ্য হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল হাতে।
লিখেছেন – সৌমক পোদ্দার