বাঁশিওয়ালা কৃষ্ণ নয়, চক্রধারী শ্রীকৃষ্ণই হিন্দুদের আরাধ্য: দেবাশিস সাহা।

দেবাশিস সাহা: আজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২৫২তম মহাজন্মাষ্টমী পূণ্যতিথি। শুভ মহাজন্মাষ্টমী-১৪৩২ বঙ্গাব্দ। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’- শব্দচয়নকে যিনি শাস্ত্রাকারে রূপ দিয়েছেন, তিনিই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতিথির রোহিনী নক্ষত্রের মহাপ্রলয়ংকরী তিমিরতার এক বিচিত্র মায়ার আবেশে বিষ্ণুর অষ্টমাবতার ও স্বয়ং ভগবান হিসেবে ত্রিভূবনখ্যাত যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরার রাজা কংসের কারাগারে মাতা দেবকীর কোলে অষ্টম সন্তানরূপে আবির্ভূত হন।

যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলার বিবিধ তাত্ত্বিকতা ও বর্হিঃপ্রকাশ মহাভারত, ভাগবত পুরাণাদিশাস্ত্রে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের (২৩-৪০ অধ্যায়) অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৭-৮ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তাঁর দেহলীলা সম্পর্কে উদ্ধৃত করেছেন-

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/৭।।

সরলার্থ: হে ভারত ! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/৮।।

সরলার্থ: সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

ভাগবতমের একাদশ স্কন্ধের ষষ্ঠ অধ্যায়ের বর্ণনানুসারে, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর পৃথিবীতে দেহলীলা করেন ও ভাগবত পুরাণের দ্বাদশ স্কন্ধের বর্ণনানুসারে শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের শেষে এবং কলিযুগের সূচনায় দেহলীলা সংবরণ করেন ইত্যাদি। সর্বাধিক তাত্ত্বিকতায় ভারত যুদ্ধ তথা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই শ্রীকৃষ্ণকে ‘ভগবান’ (যিনি ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য-এই ছয়টি গুণের অধিকারী) রূপে পাওয়া যায়, আনুমানিক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় পুলকেশীর আই হোলি শিলালিপিতে ভারত যুদ্ধের কাল ৩১০২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে উল্লিখিত হয়েছে। পক্ষান্তরে কলহন ও জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহিরের মতে ভারত যুদ্ধ বা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল আনুমানিক ২৪৪৮ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ এবং আধুনিক অনেক পণ্ডিতগণের মতে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব নবম/দশম শতকের দিকে, কিন্তু যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমান্বিত গুণাবলীর বিবিধ বর্ণনা ছান্দোগ্য উপনিষদ’সহ বৌদ্ধ ঘটজাতকে, জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথে, মহাবৈয়াকরণ পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’র সূত্র এমনকি পতঞ্জলির মহাভাষ্যেও পাওয়া যায়। তাই শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক বা অলৌকিক তাত্ত্বিকতা আরো বহপূর্বের বলেও অনুমান করা যায়। তবে একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে, যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে সর্বাধিক আলোচনা, সমালোচনা, দর্শন বা চারিত্রিক বর্ণনা পাওয়া যায় মহাভারত গ্রন্থ ও ভাগবত পুরাণশাস্ত্রাদিতে, সেই অনুসারে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যুগলীলাবৃত্ত আংশিক তুলে ধরছি-

জন্মবৃত্তান্ত:

স চাপি কেশৌ হরিরুদ্ধবই শুক্লমেকমপরং চাপি কৃষ্ণম৷৷ ৩২৷৷
তৌ চাপি কেশৌ নিবিহোতা যদুনাং কুলে স্প্রিয়ো দেবকৌ রোহনী চ।
তয়োরহেকো বলদেবো বস্তুব যেসৌ শ্বেতস্তস্য দেবস্য কেশঃ।
কৃষ্ণ দ্বিতীয়ঃ কেশবঃ সম্যভূব কেশে যোসৌ বর্ণতঃ কৃষ্ণ উক্ত।। ৩৩৷৷


(মহাভারত আদি পর্ব, অঃ ১৯৬, শ্লোক ৩২-৩৩)


সরলার্থঃ সেই সময় ভগবান নারায়ন নিজ কেশ উৎপাটন করলেন। যার মধ্যে একটি শ্বেত বর্ণ দ্বিতীয় শ্যাম বর্ণ। সেই দুই কেশ যদুবংশী দুই স্ত্রী দেবকী তথা রোহিনীর মধ্যে প্রবিষ্ট হলো। তার মধ্যে রোহিনীর গর্ভে বলদেব প্রকট হলো যা নারায়নের শ্বেত কেশ ছিলো। দ্বিতীয় কেশ যা শ্যাম বর্ণের তা দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণরূপে প্রকট হলো।

কংস বধ:
মহাভারত সভাপর্বে কংস বধ প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এরূপ বৃত্তান্ত বলে যে,

হতৌ কংশসুনামানৌ ময়া রামেন ব্যপ্যুতে।।

(মহাভারত সভা পর্ব ১৪।৩৪)

অর্থাৎ: আমি এবং বলরাম কংস এবং সুনামাকে বধ করি।

তথা কংস মহাতেজা জরাসন্ধেন পালিতঃ।
বিক্রমেণৈব কৃষ্ণেন সগণঃ পাতিতো রণে! ||৬||

(মহাভারতম্ দ্রোণপর্ব অধ্যায়ঃ ১১)

সরলার্থ: মহাবলবান তেজস্বী জরাসন্ধের দ্বারা পালিত কংসকে তাঁর সাথী সহিত যুদ্ধে পরাক্রমশালী শ্রীকৃষ্ণ বধ করেন।

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপনয়ন ও শিক্ষা লাভ:
আচার্যবর্গের নিকট শ্রীকৃষ্ণের উপনয়ন এবং সান্দিপানি মুনির আশ্রমে বেদ শিক্ষা লাভ –

ততশ্চ লব্ধসংস্কারৌ দ্বিজত্বং প্রাপ্ত সুব্রতৌ।
গর্গাদ যদুকুলাচার্যাদ্ গায়ত্রং ব্রতমাস্থিতৌ।।

(ভাগবত ১০।৪৫।২৯)

সরলার্থ: এইপ্রকার শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম যদুকুলাচার্যবর্গের নিকট উপনয়ন সংস্কার প্রাপ্ত হয়ে দ্বিজত্বে উপনিত হলেন এবং গায়ত্রী ধারণ ধারণপূর্বক ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত হলেন।

পরবর্তীতে, তাঁরা সান্দিপানি মুনির আশ্রমে বেদ শিক্ষা লাভ করেন:-

তয়োর্দ্বিজবরস্তষ্টং শুধভাবানুবৃত্তিভিঃ।
প্রোবাচ বেতানখিলান্ সাঙ্গোপরিষদো গুরু।।


(ভাগবত ১০।৪৫।৩৩)

সরলার্থ: গুরুবর সান্দীপনি মুনিও তাঁদের সেবাপরায়নতা ও শুশ্রুষায় পরম সন্তুষ্ট হয়ে উপনিষদ্ এবং ষড়ঙ্গ’সহ সমগ্র বেদ উপদেশ করলেন।

এ প্রসঙ্গে পান্ডবপুত্র ভীষ্ম শ্রীকৃষ্ণের গুণের কথন করে বলেন যে,

বেদ বেদাঙ্গ বিজ্ঞানং বলং বাচ্যধিকং তথা।
নৃণাং লোকে হি কোহন্যোস্তি বিশিষ্টঃ কেশাবাবৃতে।।
সন্নতি শ্রীধৃতিস্তুষ্টিঃ পুষ্টিশ্চ নিয়তাচ্যুত্যে।
দানং দাক্ষ্যং শ্রুতং শৌর্যং ক্রিং কীর্ত্তিবুদ্ধিরুত্তমা।

(মহাভারত সভা পর্ব ৩৮/১৯,২০)

অর্থাৎ: বেদ বেদাঙ্গ, বিজ্ঞান এবং বল আদি সবগুণ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে বিদ্যমান। মনুষ্য লোকে কেশব (শ্রীকৃষ্ণ) অপেক্ষা আর কে এমন অধিক গুনসম্পন্ন?

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিবাহ:
শ্রীকৃষ্ণ বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কণ্যা রুক্মিনীকে তাঁর সম্মতিতে হরণপূর্বক বিবাহ করেন। কারণ রুক্মিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে শিশুপালের সহিত বিবাহ দেওয়া হচ্ছিলো।
মহাভারত সভাপর্বে এ প্রসঙ্গের উল্লেখ করে শ্রীকৃষ্ণ বলেন-

রুক্মিমণ্যামন্য মূঢ়স্য প্রার্থনাসীম্মুমূর্ষত।।

(মহাভারত সভাপর্ব ৪৫।১৫)

অর্থাৎ: এই মুঢ় (শিশুপাল) মুত্যু অভিলাষী হয়ে রুক্মিনীর সাথে বিবাহের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তপস্যা:
সহস্রবর্ষ সেই কল্যাণস্বরূপ পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করেন।

পূর্ণ বর্ষসহস্রং তু তপ্তবানেষ মাধবঃ।
প্রমাদ্য বরদং দেবং চরাচরগুরু শিবম্।।

(মহাভারত পর্ব, অঃ১৪, শ্লোক ১২)

সরলার্থ: এই মাধব বরদায়ক দেব চরাচরগুরু ভগবান শিবকে প্রসন্ন করে পূর্বকালে পুরো এক হাজার বর্ষ পর্যন্ত তপস্যা করেছিলো।

পান্ডবপুত্র অর্জুনকে গীতাজ্ঞান দান:
শ্রীমদ্ভগবতগীতা শ্রীকৃষ্ণের এক অনবদ্য অবদান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে বিষন্ন অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ যোগস্থ হয়ে গীতা জ্ঞান দান করেন-

পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।

(অশ্বমেধিক পর্বঃ অঃ ১৬ শ্লোক ১৩)

অর্থাৎ: শ্রীকৃষ্ণ বললেন, সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে পরমাত্মতত্ত্বের) বর্ণনা করেছিলাম।

ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারীর অভিশাপ স্বীকার:

পতিত্র শুষয়া যেন্মে তপঃ কিচিদপজিতম্।
তেন ত্বাং দূরবাপেন শল্যে চক্রগদাধর।।

(স্ত্রী পর্বঃ অঃ ২৫, শ্লোক ৪২)

সরলার্থ: চক্র এবং গদাধারী কেশব! আমি পতির সেবা দ্বারা যা কিছু তপ করেছি। সেই দূর্লভ তপবল দ্বারা তোমাকে শাপ করছি।

তমসুপস্থিতে বর্ষ ষটত্রিংশে মধুসুদন।
হতশাতিহতাত্যো হতপুত্রো বনেচর।।
অনাথবদবিজ্ঞাতো লোকেম্বনভিলক্ষিত।
কুসিতেনাভ্যপায়েন নিধনং মমবাক্যসি।।

(স্ত্রী পর্বঃ অঃ ২৫, শ্লোক ৪৪-৪৫)

সরলার্থ: হে মধুসুদন! আজ থেকে ছত্রিশ বর্ষ উপস্থিত হওয়ার পর তোমার কুটুম্ব খ্রি পুত্র সবাই নিজেদের মধ্যে লড়ে মারা যাবে। তুমি অপিরিচিত লোকের দৃষ্টিতে অচল হয়ে অনাথের সমান বনে বিচরন করবে এবং কোন নিন্দিত উপায়ে মৃত্যুকে প্রাপ্ত করবে।


তবাপ্যেং হতসুতা নিহতজ্ঞাতিবান্ধবাঃ।
স্ত্রিয়ঃ পরিপতিযন্তি যথৈতা ভরতন্ত্রিয়ঃ।।

(স্ত্রী পর্বঃ অঃ ২৫, শ্লোক ৪৬)

সরলার্থ: এই ভরতবংশের স্ত্রীদের সমান তোমার কুলের স্ত্রী ও পুত্রী তথা ভাই মারা যাবার পর তাদের শবের পাশে বিলাপ করবে।

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহলীলাসংবরন:

স কেশবং যোগযুক্তং শয়ানং – মৃগাসক্তো লুব্ধকং সায়কেন।।
জরাবিধ্যত পদতলে ত্বয়াবাং।

(মৌষল পর্ব, অঃ ৪ শ্লোক ২২-২৩)

অর্থাৎ: মৃগে আসক্ত হয়ে জরা ব্যাধ যোগেস্থিত কেশবকে মৃগ মনে করে তীর নিক্ষেপ করে তার পদতল বিদ্ধ করলেন।

পান্ডবপুত্র অর্জুন কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের অন্তিম সৎকার:
ততঃ শরীরে রামস্য বাসুদেবস্য চোভয়োঃ।
অনিষ্য দাহয়ামাস পুরুষেরাপ্তকারিভিঃ।।

(মহাঃ। মৌষল পর্ব। অঃ ৭ শ্লোক ৩১)

সরলার্থ: তদনন্তর বিশ্বস্ত পুরুষ দ্বারা বলরাম তথা বসুদেবনন্দন শ্রীকৃষ্ণ উভয়ের শরীর খোজ করে অর্জুন তাঁদের দাহ সংস্কার করলেন।

পুরষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের জন্মই যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে, কারণ তাঁর মহিমান্বিত জন্মই হয়েছে অত্যাচারিত রাজা কংসের কারাগারে। যাকে হত্যার জন্যই তাঁর পিতা-মাতাকে বন্দী রেখেছেন তাঁরই আপন মামা কংস। জন্ম থেকে লীলাসংবরণ পর্যন্ত ‘যুদ্ধময়জীবন’ শব্দবিশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেছেন আরাধ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। হাজারো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে কত অসুর, কত দানব, কত অত্যাচারিত রাজা, কত প্রতিপক্ষকে পরাজিত ও বধের মাধ্যমে শান্তির বাণী সমগ্র আর্যাবর্তে ছড়িয়েছিলেন। ভাগবত পুরাণাদির বর্ণনানুসারে-

  • মাত্র ০১ মাস বয়সে বিষমাখা স্তনপান করিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যার চেষ্টাকালে জীবনীশক্তি শোষণ করার মাধ্যমে পুতনা রাক্ষসীকে বধ করেন;
  • মাত্র ০৩ মাস বয়সে বিশালাকার রাক্ষস শকটাসুরকে মাটি থেকে বায়ুমন্ডলে তুলে পুনরায় মাটিতে নিক্ষেপ করে বধ করেন;
  • মাত্র ০১ বছর বয়সে বাতাসের ঘুর্ণিবায়ুরূপধারী তৃণাবর্ত নামক অসুরকে বধ করেন;
  • যমুনা নদীতীরে গোপবালকদের সাথে বৎস অর্থাৎ গরু চরানিকালে গরুপালের মধ্যে দৈত্যরূপে লুকিয়ে থাকা বৎসাসুরকে বধ করেন;
  • অন্যান্য গোপবালকদের সাথে গরুকে জল খাওয়ানোকালে পাখিরূপধারী অসুর বকাসুরকে দুই ঠোঁট চেপে ধরে বধ করেন;
  • বিশাল অজগর সর্পরূপী অঘাসুরকে তারই মুখগহবরে ঢুকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বধ করেন;
  • দানবানুচর কেশীকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাহু দানব কেশীর মুখগহবরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে শ্বাসরোধ করে বধ করেন;
  • অত্যাচারিত রাজা কংসের যখন শ্রীকৃষ্ণকে হত্যার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয় তখন শ্রীকৃষ্ণে পালক পিতা নন্দরাজকে বন্দী এবং উগ্রসেন ও বসুদেবকে হত্যা করার নির্দেশের প্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণ কংসকে তাৎক্ষণিক আক্রমণ করেন এবং সিংহাসন থেকে ছুড়েমেরে বধ করেন;
  • যমুনা নদীতে কালীয়নাগ নামক উন্মত্ত বিশালকায় শক্তিশালী ও বিষধর সাপের হাত থেকে নদীকে বিষমুক্ত ও সেখানকার মানুষদের রক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর চরণাঘাত দ্বারা কালীয়নাগ বধ করেন;
  • নরকাসুর নামের অসুরের কবল থেকে ১৬,১০০ জন নারীকে উদ্ধার করে তাঁদের সম্মান রক্ষাসহ নরকাসুরকে বধ করেন;
  • চেদীর রাজা শিশুপাল নামক অত্যাচারী রাজাকে বধ করার মাধ্যমে তাঁর অত্যাচারের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করেন।
  • এছাড়াও মগধ রাজা জরাসন্ধ, তারকাসুর, ত্রিপুরাসুর, মারীচ, লবনাসুর, জলন্ধর(অসুর) প্রভৃতি দৈত্য দানব অসুরকে নিজ হাতে বধ করে অত্যাচারিত জনগণকে ‍মুক্তি প্রদান করেন।

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যুগলীলায় দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে বদ্ধপরিকর ছিলেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসংখ্য অত্যাচারিত রাজা, দানব, অসুর’সহ অপরিমেয় অত্যাচারের অবসান ঘটিয়েছিলেন। যা সনাতন শাস্ত্রের অগণিত শাস্ত্রাপখ্যানে ব্যক্ত রয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ন্যায় প্রতিষ্ঠার দন্ডবিধিতে ধর্মস্থাপন হেতু মাতুলালয়, পিতৃালয় ছাড়াও আপন-পর কাউকেই ছাড় দেননি, বরং সকল অত্যাচারিতদের সমূলে বিনাশ কিংবা বধ করেছেন। সমগ্র জীবনলীলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজন জগৎশ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ ছিলেন, কেননা ত্রিভুবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিধর অস্ত্র তথা সুদর্শন চক্রের একচ্ছত্র অধিকারী হয়েও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো এই ব্রহ্মান্ডের শ্রেষ্ঠতম যুদ্ধে তিনি কোনরূপ অস্ত্রধারণ করেননি, কেবল অর্জুনের রথসারথী হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁরই কুটনৈতিক প্রভাবে নিজে অস্ত্রহীন হয়েও ইচ্ছামৃত্যুবরপ্রাপ্ত পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য্য, মহাপরাক্রমাশীল যোদ্ধা অঙ্গরাজ কর্ণ’সহ অসংখ্য রথী, মহারথী যোদ্ধাদের বধ করিয়েছিলেন। অপরদিকে বহুবার পান্ডবপুত্র অর্জুন’সহ পান্ডবপুত্র পক্ষীয় যোদ্ধাদের জীবনরক্ষা এবং রণকৌশল শ্রীকৃষ্ণই প্রদান করেছিলেন। এমনকি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে অর্জুনের জয়দ্রথ বধ অথবা নিজে অগ্নিস্নান প্রতিজ্ঞায় প্রায় হেরে যাওয়া অর্জুনকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে সূর্যের চারপাশে মায়া সৃষ্টি করে সুঁনিপুণ কৌশলতার সাথে বিজয়ী এবং ধৃতরাষ্ট্র জামাতা তথা দুর্যোধন ভগ্নিপতি জয়দ্রথকে বধ করিয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শুধু তাঁর নিজ রাজ্যে দ্বারকাকে সমসাময়িক অন্যান্য রাজ্যেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রজাভূমি হিসেবে বিনির্মাণ করেননি, বরং আর্যাবর্তের সকল রাজ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা তথা ধর্মস্থাপনে নিরলস প্রচেষ্টা করেছেন, যেমনটি করেছেন হস্তিনাপুর রাজ্যে পান্ডবপুত্র যুধিষ্ঠিরের রাজক্ষমতায়নে। বলা চলে সহায় সম্বলহীন রিক্তহস্ত পান্ডবপুত্রদের একমাত্র শক্তির বাতিঘর ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, আর্যাবর্তের রাজাদের সাথে সন্ধি, সামরিক কৌশলবৃদ্ধি, যুগোপযোগী পরিকল্পনা, এমনকি অন্যান্য রাজ্যের রাজসহযোগীতা আনয়নে মূল জামিনদারের ভূমিকা শ্রীকৃষ্ণই পালন করেছিলেন।

চক্রধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামগ্রিক জীবনদর্শন তথা জন্ম থেকে জীবনলীলা সংবরণ পর্যন্ত সমগ্র জীবনভর শুধু যুদ্ধ, সংগ্রাম, প্রতিবাদ আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি দ্বারাই পরিপূর্ণ। যেখানেই দুষ্টের ছোঁয়া পেয়েছেন সেখানেই দমনের শিহরণ জাগিয়েছেন, করেছেন রাজনীতি, অলৌকিক মায়া, কৌশলী পরিকল্পনা, অপ্রতিরোধ্য বাগ্মীতা, বিচক্ষণতা প্রভৃতি, যেমন কৌশল কুটনীতিতে অর্জুনকে জাগিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ময়দানে উদ্ধৃত করেছেন –

হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্ ।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ ॥

গীতা ২/৩৭॥

সরলার্থ: হে কুন্তীপুত্র ! এই যুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে ৷ অতএব যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উত্থিত হও।

ভীরুতা, দুর্বলতা ত্যাগ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধৃত করেছেন-

ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে ।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরমন্তপ ॥

গীতা ২/৩॥

সরলার্থ: হে পার্থ ! এই সন্মান হানিকর ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না৷ এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত । হে পরন্তপ ! হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও।

কর্ম ও অধিকার সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধৃত করেছেন-

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥

গীতা ২/৪৭॥

সরলার্থ: স্বধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কোন কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কখনও নিজেকে কর্মফলের হেতু মনে করো না, এবং কখনও স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও আসক্ত হইয়োনা।

আবার সকল ধর্ম-অধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল তাঁরই শরণাগত হতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধৃত করেছেন –

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥

গীতা ১৮/৬৬॥

সরলার্থ: সর্ব প্রকার অধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।

পুরষোত্তম, যোগেশ্বর ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যুগলীলার আলোকে বলা যায়, তিনি একইসাথে মহাপরাক্রমাশীল অপরাজিত যোদ্ধা, শ্রেষ্ঠ যুদ্ধকৌশল পরিকল্পনাকারী, শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও অপ্রতিরোধ্য বাগ্মী ও মহাবিচক্ষণশীল ব্যক্তিত্ব’সহ সহস্রগুণে গুনান্বিতখ্যাত যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ত্রিভূবনে সমাদৃত। তিনি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের কিসে মুক্তি, কিসেইবা তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের কর্ম ও অধিকার। সুতরাং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনাচরণ অনুরূপ দর্শন পালন ও সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিফলনের মাধ্যেমে উত্তম জীবনাচরিত ও রাষ্ট্র গঠনই হিন্দুদের একমাত্র মুক্তির পথ। তাই বাঁশিওয়ালা কৃষ্ণ নয়, বরং চক্রধারী শ্রীকৃষ্ণই হিন্দুদের আরাধ্য।

লিখেছেন –
দেবাশিস সাহা
অধ্যক্ষ
আর্য সংস্কৃত কলেজ, ঢাকা।

One thought on “বাঁশিওয়ালা কৃষ্ণ নয়, চক্রধারী শ্রীকৃষ্ণই হিন্দুদের আরাধ্য: দেবাশিস সাহা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *