পশুবলি সমাচার : প্রিয়ন্ত চক্রবর্ত্তী

পশুবলি সমাচার : প্রিয়ন্ত চক্রবর্ত্তী

লেখক : প্রিয়ন্ত চক্রবর্ত্তী

প্রশ্ন : পশুবলির কথা কি শাস্ত্রে আছে?
উত্তর : আছে।

প্রশ্ন : কোন্ শাস্ত্রে আছে?
উত্তর : তন্ত্রে ও পুরাণে আছে।

প্রশ্ন : আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল বেদ। আমাদের বেদ মান্য করা উচিত নয় কি?
উত্তর : দেবদেবীদের পূজাগুলো বেদ থেকে আসে নি। এগুলো তন্ত্র ও পুরাণের পূজা। তাই এগুলোর আচার-অনুষ্ঠানও তন্ত্র এবং পুরাণ অনুসারেই হয়।

প্রশ্ন : কিন্তু এটা কেমন নিয়ম! ছাগল তো মায়ের সন্তান। মা কি তাঁর সন্তানের রক্ত চাইতে পারেন?
উত্তর : তিনি তো জগজ্জননী। মহিষাসুর, রক্তবীজ, শুম্ভনিশুম্ভ এরাও মায়ের সন্তান ছিলো। এদের এবং এদের সকল সৈন্যের রক্তপাত মা নিজেই করেছেন। রক্তবীজের রক্ত পান করেছেন তিনি।

প্রশ্ন : অসুরের সাথে নিরীহ ছাগলের তুলনা?
উত্তর : ছাগল একদমই নিরীহ নয়! পূর্ব জন্মে অপকর্ম করেছে বলেই এই জন্মে সে ছাগল হয়ে জন্মেছে। মায়ের চরণে বলি হয়ে বরং তার কষ্টকর পশুজন্ম ঘুচলো।

প্রশ্ন : পশুবলি কি বাধ্যতামূলক? কি দরকার পূজার মত সাত্ত্বিক অনুষ্ঠানে প্রাণী হত্যার মত হিংসামূলক কাজ করার?
উত্তর : মা কালী তমোগুণী দেবী৷ তমোগুণ বলতে খারাপ নয়, বরং সুখের বিপরীত দিকটা বুঝায়। শুধু সুখের দ্বারা জগতের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। সুখ-দুঃখ, দিন-রাত, আলো-অন্ধকার উভয় মিলেই জগতের অস্তিত্ব। তমোগুণী দেবীর পূজায় তাই এই প্রাণী হত্যারূপ হিংসা। আর একে যদি হিংসা বলে নাক ছিটকাই তাহলে স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বংশে জন্মে যুদ্ধ করতে গিয়ে কত কত হত্যা করেছে তার হিসেবে নেই! সেগুলো হিংসা ছিলো না? আসল কথা হল ধর্মকার্যকে সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে অনেককিছুই করতে হয়। আর দেবী কালীরই একেক রূপ হল দেবী দুর্গা, দেবী মনসা। তাদের পূজাতেও বলিপ্রদান করা হয়।

প্রশ্ন : ঠিক আছে বুঝলাম, তাও তো আমরা পশুর বদলে সবজী বলি দিতে পারি? যেমন চালকুমড়া, আঁখ, কলা ইত্যাদি।
উত্তর : অবশ্যই পারি। রামকৃষ্ণ মিশনে এগুলোই বলি দেয়। স্বামী বিবেকানন্দ পাঠা বলি দিতে চেয়েছিলেন তবে সারদা মা বলেছেন সন্ন্যাসীদের পাঠা বলি দেওয়াটা ঠিক হবে না, কারণ সন্ন্যাসীর নীতি অহিংসা। তাই রামকৃষ্ণ মিশনে সবজী বলি হয়। তবে আপনি তো সন্ন্যাসী নন, আমরা তো সন্ন্যাসী নই! তাহলে কিসের এত দ্বিধা? আর যদি সংসারী হয়েও আপনি সবজী বলি দিতে চান তাহলে অবশ্যই দিতে পারেন। কেউ আপনাকে বাধা দিবে না। তবে হ্যাঁ, আপনিও অন্যের পশুবলিতে বাধা দিতে পারেন না।

প্রশ্ন : আসলে এখন কয়জনই বা মায়ের পূজার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়? সকলেই নিজে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে বলি দেয়।
উত্তর : সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না যে কে কোন্ উদ্দেশ্যে বলি দিলো। শাস্ত্রসম্মত কাজ হচ্ছে সেটাই আসল কথা। আর আপনারা যে ফল, মিষ্টি, পায়েস ভোগ দেন সেগুলো কি না খেয়ে ফেলে দেন? সেগুলোও তো নিবেদন করার পরে খান। তাহলে নিবেদিত মাংস খেতে সমস্যা কোথায়?

প্রশ্ন : না তারপরেও পূজার মধ্যে এমন কাজ আসলে মানতে পারি না!
উত্তর : সেটা আপনার মেন্টালিটির সমস্যা। সারাবছর মাংস খেতে পারেন, আর বলি হবে শুনলেই নাক ছিটকান! বরং সারাবছর যে মাংস খান তার চেয়ে এই বলির মাংস অধিক পবিত্র। কারণ এটি দেবীর চরণে নিবেদিত৷ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “দেবতা প্রদত্ত বস্তু দেবতাকে নিবেদন না করে গ্রহণ করলে সে চোর। নিবেদিত ভোজনই মানুষকে পাপমুক্ত করে”। পশুর মাংসটাও এভাবে দেবতাকে নিবেদন করা হল। শ্রীকৃষ্ণ আর কালীতে কোনো ভেদ নেই। ঈশ্বর সত্ত্বগুণী রূপী শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণু হয়ে ফল-মিষ্টি গ্রহণ করেন আবার একই ঈশ্বর তমোগুণী রূপী কালী হয়ে পশুর বলি গ্রহণ করেন।

প্রশ্ন : অও আচ্ছা! তবে দাদা আমাদের উচিত বেদের আশ্রয় গ্রহণ করা।
উত্তর : তো করুন না! কে বাধা দিলো? বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্র সব মিলেই আমাদের সনাতন ধর্ম। আপনার যে শাস্ত্র ভালো লাগে, যে মার্গ ভালো লাগে, যে ধরণের পূজা করতে ভালো লাগে আপনি সেটাই করুন, সেগুলো নিয়েই থাকুন। তবে কখনোই অন্যের কৃত ধর্মকার্য নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না। কারণ আলাদা আলাদা লোকের রুচিও আলাদা হয়৷ বৈদিক, পৌরাণিক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত ইত্যাদি সকল মত, সকল পথ নিয়েই আমাদের সনাতন ধর্ম। সব পথেই সেই পরমেশ্বরকে পাওয়া যায়। এজন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “যত মত তত পথ”

প্রশ্ন : আচ্ছা দাদা, শেষ একটা প্রশ্ন করি, আপনার কোন্ মত ভালো লাগে?
উত্তর : আমার সনাতনধর্ম ভালো লাগে। কোনো নির্দিষ্ট মতকে আমি প্রাধান্য দেই না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “মতুয়া ধর্ম পালন করবে না”। মতুয়া ধর্ম মানে কোনো নির্দিষ্ট মতকে নিয়ে গোড়ামি করা। আমি কোনো নির্দিষ্ট মতকে নিয়ে গোড়ামি করি না। আমার কাছে বৈষ্ণবের ফল-মিষ্টি নিবেদন আর শাক্তের পশুবলি প্রদান একই মাহাত্ম্য বহন করে৷ বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী এরা একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ। আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্র ঋগ্বেদেই বলা আছে, “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি”। অর্থাৎ, পরম সৎ বস্তু(ঈশ্বর) একজনই আছেন। জ্ঞানীগণ তাঁকে বহু নামে ডাকেন।

ইতি
প্রিয়ন্ত চক্রবর্ত্তী কৃত “পশুবলি সমাচার”
সমাপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *