
‘একনিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল। এত দিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা ঘর পুড়িয়ে দিল, দোকানটাও জ্বালিয়ে দিল। তারা তো শুধু আমার ঘর ও দোকান পোড়ায়নি, আমার ভাত খাওয়ার অবলম্বনও নিয়ে গেছে। এখন আমি কীভাবে চলব? আমার দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ কীভাবে দেব?’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লা সা প্রু মারমা। স্বামীহারা লা সা প্রু সংসার চালাতেন স্থানীয় বাজারে থাকা ছোট্ট কাপড়ের দোকানের আয়ে। এখন সেই দোকানটিও নেই, নেই বসতবাড়ি। জীবনের অবলম্বন হারিয়ে হতাশায় ডুবে আছেন তিনি। সোমবার বিকেলে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় কথা হয় লা সা প্রু মারমার সঙ্গে। পোড়া বাড়ির সামনের টিলায় ছোট মেয়ে ও স্বজনদের নিয়ে বসেছিলেন তিনি। পাশে ছিলেন দুই জা (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী)। তাঁদেরও ঘর পুড়েছে, পুড়েছে দোকান।
রামেসু বাজার এলাকার বাসিন্দারা একদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন, আরেক দিকে জীবিকা আয়ের অবলম্বন দোকানও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—এখন সর্বস্ব হারানো বাসিন্দারা পড়েছেন অকূলপাথারে।
আগুনের লেলিহান শিখা শুধু তাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়নি, বেঁচে থাকার অবলম্বনও শেষ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীর দিনগুলো শুধুই অন্ধকার দেখছেন লা সা প্রু মারমার মতো এই বাজারের পাহাড়ি নারীরা।
ঘর-দোকান হারানোর শোকে ক্ষোভ জন্মেছে লা সা প্রু মারমার মনে। ক্ষুব্ধ এই পাহাড়ি নারী বলতে থাকেন, ‘সবাই শুধু আগুনের তালে থাকে। কিছু হলেই আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেবে? কেন দোকান জ্বালিয়ে দেবে? তার চেয়ে আমাদের মেরে ফেলুক।’
লা সা প্রু মারমার দুই জা-শিনু চিং চৌধুরী ও হ্লা পাই মারমাও হারিয়েছেন সবকিছু। শিনু চিং চৌধুরী, স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষিকা। ঋণ নিয়ে বাজারে দোতলা ভবন করে দোকান দিয়েছিলেন তিনি। দোকানের আয় ও বেতনে চলত সংসার, সন্তানের পড়াশোনার খরচও। তাঁর বড় মেয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় কোচিং করছে। এখন শিনু চিংয়ের দোকানটির সঙ্গে ঘরও পুড়ে ছাই।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার দুপুর বেলা জীবনের বেদনাদায়ক মুহূর্ত হয়ে থাকবে শিনু চিং চৌধুরীর। দুঃসহ সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন এই নারী। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। বলতে থাকেন, ‘ভয়ে প্রথমে বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছিলাম। পরে বের হয়ে আসি। অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে কোনোরকম জান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কী ঘটেছে, কী হয়েছে, তার কিছুই আমরা জানি না; কিন্তু আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। দোকানটাও পুড়িয়ে দিল।’
সামনের দিন নিয়ে শঙ্কার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই স্কুলশিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘ঋণ শোধ করব কীভাবে? সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেব কীভাবে? ঘর চালাব নাকি লোন শোধ করব?’ বসতবাড়ি হারানো শিনু চিং চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘যখনই কোনো সমস্যা হয়, তখনই ঘর পুড়িয়ে দেয়। ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেবে? ঘর কী দোষ করেছে?’
অন্য জা হ্লা পাই মারমার আয়ের উৎসও ছিল একটি কাপড়ের দোকান। সেই দোকান ও বসতঘর দুই-ই পুড়ে গেছে। এখন দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। দুই মেয়ের একজন পড়েন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ)। ছোট মেয়ে এবার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে জা হ্লা পাই মারমা বলেন, ‘এক কাপড়েই ঘর ছেড়েছি। কিছুই বের করতে পারিনি। ঘরের সবকিছু পুড়ে ছাই।’
এই তিন পাহাড়ি নারীর দুশ্চিন্তা—সব তো হারিয়েছেন, এখন নতুন করে কীভাবে ঘর করবেন। কীভাবে দোকান চালু করবেন তার কোনো দিশা পাচ্ছেন না। এসব করতে যে টাকার দরকার, তা তাঁদের নেই।
বড়দের মতো সহিংসতার আগুন কেড়ে নিয়েছে শিশু-কিশোরদের স্বপ্নও। হ্লা পাই মারমার ছোট মেয়ে ক্ল্যাচিং প্রু মারমা সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। নতুন বই কিনে পড়ার আনন্দটাও উপভোগ করতে পারেনি সে। তার বইগুলোও ভস্মীভূত হয়েছে আগুনে। চোখ ভরা জল নিয়ে বলল, ‘নতুন বইগুলো এখনো ভালো করে উল্টে দেখার সুযোগ পাইনি। তার আগেই ওরা আমার নতুন বইগুলো পুড়িয়ে দিল।’
বলার সময় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে এই কিশোরীর। চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। কান্নার আওয়াজ নেই। কিন্তু মায়ের দুঃখ, নতুন বইয়ের শোক, ভেঙেচুরে দিয়েছে ক্ল্যাচিংকে।
রোববারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে, ‘সকাল থেকে মিছিল-মিটিং হচ্ছিল। আমাদের পাড়ার কেউ তো সেখানে ছিল না। তার পরেও আমাদের ঘরবাড়ি-দোকান সব জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। যখন আগুন দিচ্ছিল, তখন আমি, মা ও বাবা তিনজন তিন দিকে পালিয়ে যাই। কে কোন দিকে যাচ্ছি তার কিছুই জানতাম না। যাওয়ার আগে শুধু সার্টিফিকেটগুলো (সনদ) নিতে পারছি।’
ক্ল্যাচিংয়ের প্রশ্ন, ‘তারা (আগুন দেওয়া ব্যক্তিরা) আমাদের ঘর কেন জ্বালিয়ে দিল? জিনিসপত্র নিয়ে যেত। অন্তত রাতে তো ঘরে থাকতে পারতাম।এখন সে সুযোগটুকুও নেই।’
শিনু চিং চৌধুরী, লা সা প্রু মারমা, হ্লা পাই মারমা, ক্ল্যাচিং মারমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পরে নামবে রাতের আঁধার। রামেসু বাজারের আগুন শুধু ঘরবাড়ি পোড়ায়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে পাড়াবাসীর ভবিষ্যৎ, শিশুদের শিক্ষা, নারীদের আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন। এখন তাঁদের চোখে শুধু অশ্রু, দুঃখ-ক্ষোভ আর অন্তরে ভয়—আগামী দিনের অন্ধকার অনিশ্চয়তা।
উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রীকে তিন সেটেলার বাঙালি যুবক গণধর্ষণ করে। এই গণধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কয়েকদিন ধরেই চলছিলো বিক্ষোভ-অবরোধ কর্মসূচি। তার এই ধারাবাহিকতায় ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবারও ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে সকাল সন্ধ্যা অবরোধ চলছিলো। গুইমারা রামেসু বাজার এলাকায় গুইমারা টাউন হলের সামনে অবরোধ পালনকালে দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনী অবরোধকারী জুম্ম ছাত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। গুইমারায় রামেসু বাজারে সেনাবাহিনী এবং সেটলার বাঙালিদের হামলা-গুলিবর্ষণে অন্তত ১০ জন আদিবাসী আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক খবরে জানা গেছে। পরে ৩জন আদিবাসী মারা গেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি আদিবাসীদের দোকানপাট এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে।