আমার ঘরবাড়ি না পুড়ে, আমাকেও আগুনের মধ্যে দিয়ে দিত।

ছবি: মিবু মারমা।

রামেসু বাজার এলাকায় আগুনে বসতবাড়ির সবটুকু পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। পড়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া টিন। এর ভেতরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ভস্মীভূত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। উঠানে পড়ে আছে পোড়া মোটরসাইকেলের কাঠামো। রক্ষা পায়নি আয়–উপার্জনের দোকানটিও।

এ রকম বিধ্বস্ত বসতভিটার পাশে বিষণ্ন মনে বসে ছিলেন মিবু মারমা। ঘর হারানো কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর স্বামী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সদস্য।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার সময় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মিবু মারমার বাড়ি ও খাবারের দোকান। ওই দিন সহিংসতার সময় বাজারের দোকানপাট, বসতঘর ও ভবনে আগুন দেওয়া হয়। বসতঘর ও দোকানমালিকদের অধিকাংশই পাহাড়ি। সোমবার সকালেও বাজারের বিভিন্ন দোকান থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।

শুধু মিবু মারমার ঘর নয়, বাজারজুড়ে চারদিকে পোড়া ক্ষত। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরেও কিছু ঘর টিকে থাকলেও তা আর মেরামতের উপযোগী নেই। সব হারানো পাহাড়ি মানুষের অবস্থা এখন অসহায়। তাঁদের কারও চোখে জল, কারও মধ্যে রাগ–ক্ষোভ। আবার এর মধ্যে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে পাড়াবাসীর মধ্যে।

বসতবাড়ি ও দোকান পুড়ে যাওয়ায় সামনের দিন নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন মিবু মারমা। তাঁর বেদনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আগুন থেকে মেয়ের আদুরে বিড়ালকে রক্ষা করতে না পারার কষ্ট।

মিবু মারমা বলেন, ‘কিছুই নাই, সব ছাই। ছাইয়ের ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। ঢুকেও গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বজনেরা আটকিয়েছিলেন। আমার ঘরবাড়ি না পুড়ে, আমাকেও আগুনের মধ্যে দিয়ে দিত। তাহলে আর এত দুঃখ–কষ্ট সহ্য করতে হতো না।’

বসতবাড়ি হারিয়ে মা, বাবা ও বোনদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাড়ির সামনে বসে ছিলেন চিয়া প্রু মারমা। পুড়ে যাওয়া বসতঘর দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নার্সিং কলেজে পড়ুয়া চিয়া প্রু মারমা। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাড়ার কেউ অবরোধে অংশ নেননি। আমরা কিছুই করিনি। এরপরও বাইরে থেকে লোকজন এসে আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। বই, কলম, খাতাও পুড়িয়ে ফেলেছে। এক কাপড়ে বের হয়েছি, সেভাবেই আছি এখনো।’

চিয়া প্রু মারমার বাবা মূলত কৃষক। এর পাশাপাশি দোকানও রয়েছে। তাঁদের বাড়িটি আধা পাকা। সামনে প্রশস্ত উঠান। বাড়ির আঙিনাজুড়ে গাছের সারি। নানা ধরনের বৃক্ষরাজিতে ভরা বাড়ির প্রাঙ্গণ। আম, লিচু, সুপারি, নারকেলগাছের সমাহার। আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপ ছুঁয়ে গেছে নিরীহ বৃক্ষরাজির ওপর। আগুনে পোড়া গাছগুলো মানুষের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রামেসু বাজারে সড়কের দুই পাশে থাকা দোকানপাট ও বসতঘর পুরোপুরি পুড়ে গেছে। শুধু আগুনে পোড়া অবকাঠামোগুলো কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও তা–ও নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সব। রাস্তা ও রাস্তার পাশে পড়ে ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলগুলো।

আগুনের উত্তাপ কমে গেলেও উত্তেজনা কমেনি পাড়াবাসীর মধ্যে। আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা। অনেক তরুণ ও যুবক গ্রেপ্তারের ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন।

রামেসু বাজারে সরেজমিন গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা পাইসং মারমা। পাড়ার লোকজন জানান, আগুনে তাঁর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাড়ার বাসিন্দারা জানান, গুইমারার রামেসু বাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। খাগড়াছড়ি শহরসহ আশপাশের উপজেলার লোকজন কাপড় কিনতে এখানে ছুটে আসেন। এবারের আগুনে কাপড়ের দোকানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রামেসু বাজার পাড়ার বাসিন্দা সাহ্লা প্রু মারমা বলেন, কারা হামলা করেছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়ি–বাঙালির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বুঝে নিন পাহাড়িদের পাড়ায় কারা আগুন দিয়েছে। আগুনে অন্তত ৪০টি দোকান, ৫০টি বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। কিছু গুদামও পুড়েছে। গরু–ছাগলও লুট করে নিয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রীকে তিন সেটেলার বাঙালি যুবক গণধর্ষণ করে। এই গণধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কয়েকদিন ধরেই চলছিলো বিক্ষোভ-অবরোধ কর্মসূচি। তার এই ধারাবাহিকতায় ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবারও ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে সকাল সন্ধ্যা অবরোধ চলছিলো। গুইমারা রামেসু বাজার এলাকায় গুইমারা টাউন হলের সামনে অবরোধ পালনকালে দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনী অবরোধকারী জুম্ম ছাত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। গুইমারায় রামেসু বাজারে সেনাবাহিনী এবং সেটলার বাঙালিদের হামলা-গুলিবর্ষণে অন্তত ১০ জন আদিবাসী আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক খবরে জানা গেছে। পরে ৩জন আদিবাসী মারা গেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি আদিবাসীদের দোকানপাট এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *