
প্রায় ছোটবেলা থেকেই দুটো জায়গার নাম খুব শুনেছি। মালাপ্পুরম ও কোহাট। প্রথমটা কেরল, দ্বিতীয়টা পাকিস্তানের উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। ১৯১৯ সালে গান্ধীজী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলনকে যুক্ত করে ভারতের রাজনীতিতে এক ভয়ঙ্কর মুসলিম তোষণনীতির নজির সৃষ্টি করেছিলেন। তারই পরিণামে এই দুই জায়গায় ভয়ঙ্কর হিন্দু বিরােধী দাঙ্গা হয়েছিল যাতে হাজার হাজার হিন্দুকে কচুকাটা করেছিল সাম্প্রদায়িক মুসলিমরা । ১৯২১ সালে মালাধুরমে ও ১৯২৪ সালে কোহাটে।
কোহাট তাে এখন যাওয়ার উপায় নেই। তাই মালাপ্পুরম দেখবাে, সেখানে হিন্দু গণহত্যার জায়গাগুলাে দেখবাে , সেইসব ঘটনার কোন স্মৃতি এখনও হিন্দুদের মনে আছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করবাে এবং এখন হিন্দুদের পরিস্থিতি ও মানসিকতা কি, ঐ ঘটনার কোন প্রতিকারের কথা তারা ভাবে, না পরাজয়কে স্বীকার করে নিয়েছে সেটা বােঝার চেষ্টা করবাে, এই ইচ্ছা অনেকদিন থেকেই আমার মনে ছিল । কাজের চাপে হয়ে ওঠেনি । গত সেপ্টেম্বর মাসে ( ২০১৬ ) সেই সুযােগ হল । সঙ্গে পেলাম বর্তমানে বিদেশে বসবাসকারী আমার এক সমর্থক বন্ধুকে , যে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার । আটদিন কেরল ভ্রমণে খরচের প্রায় সবটাই তার উপর দিয়ে গেল ।
এই মালাপ্পুরম নামটা নতুন । আগে একে মােপলাস্থান নামে ডাকা হত , তারও আগে এই অঞ্চলে ঐতিহাগত নাম মালাবার । এটা কেরলের উত্তর অংশে অবস্থিত । আদিগুরু শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান কালাডি এই কেরলেই অবস্থিত । ১৮৯২-৯৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দ যখন পায়ে হেঁটে সারা ভারত ভ্রমণ করছেন তখন এই মালাবার ভ্রমণ করে তিনি একে বলেছিলেন , পাগলা গারদ ( Land of lunatics ) । এখানকার জাতপাত ও ভেদাভেদের তীব্রতা দেখে তিনি একথা বলেছিলেন । হরিজনদেরকে এই মালাবারে গলায় ঘন্টা বেধে যেতে হত যাতে সেই ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ব্রাহ্মণরা রাস্তার পাশে সরে গিয়ে হরিজনদের ছোঁয়া ও ছায়া থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিজেদের জাতরক্ষা করত ।
১৯৫৭ সালে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে কেরলে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয় । সারা পৃথিবীতে সেটাই ছিল প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার । তারপরেও অনেকবার নির্বাচনে জিতে কমিউনিস্টরা এখানে সরকার গঠন করেছে । এই কমিউনিস্ট সরকারই ১৯৬৯ সালে কোঝিকোড ও পালক্কাড জেলা থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে এই মালাপ্পুরম নামে নতুন জেলা গঠন করে যাতে জেলাটি মুসলিম প্রধান হয় । কেরল রাজ্যের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরম । কিন্তু উত্তর কেরলের প্রধান শহর কোঝিকোড । কয়েকশ বছর পূর্বে ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো – দা – গামা আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই কোঝিকোড বন্দরে প্রথম পা রেখেছিলেন । এখানকার সমুদ্র সৈকত খুব বিখ্যাত ও আকর্ষণীয় । সঘের প্রচারক থাকাকালীন ১৯৮১ সালে আমি শ্রদ্ধেয় কেশবজী ও রথীনদার সঙ্গে এই শহরে এসেছিলাম সঙ্ঘের কাজ দেখতে । প্রথম কেরালিয়ান ( মালায়ালি ) সঙ্ঘপ্রচারক কুমারনজীর সঙ্গে কেশবজীর বােনের বিয়ে হয়েছিল । এবারও গিয়ে আমি কুমারনজী ও তার মেয়ে পদ্মাদির সঙ্গে দেখা করে এসেছি । কেশবজীর বােন জীবিত নেই । সদ্য কুমারনজী ৯৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেছেন খবর পেয়েছি ।
কোঝিকোডকে কেন্দ্র করেই ৮ দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম । একদিন গিয়েছিলাম কানুর জেলাতে যেখানে গত ৫০ বছর ধরে আর এস এস ও সি পি এম – এর রক্তাক্ত সংঘর্ষ চলছে , , যাতে বলি হয়ে গেছেন কয়েক শাে মানুষ । সকলেই । হিন্দু এবং বেশিরভাগই এড়োয়া জাতির । উভয়পক্ষেই এরাই লড়েন ও মরেন । এখানে আমার পুরানাে সহকর্মী ভি মুরলীধরণের সঙ্গেও । দেখা হয়েছে । ঘটনাচক্রে তাঁর মায়ের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় আমি উপস্থিত ছিলাম । এটা দেখে দুঃখ পেয়েছি যে ওখানে হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন জাতির শ্মশান আলাদা হয় , এখনও । সরকারী শ্মশানে সব | জাতির হিন্দুদের দাহকার্য হয় বলে শহরে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিজের বাড়িতেই মৃত ব্যক্তির দাহ করেন ।
বিখ্যাত বা কুখ্যাত ‘ মােপলা রায়ট ’ ইতিহাসে । মােপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত । কমিউনিস্টদের রচিত ইতিহাসে এই দাঙ্গাকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে । বিদ্রোহ বলা হয় এবং উত্তর ভারতে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে । কিন্তু এটা নির্জলা মিথ্যা । মােপলা মুসলিম দাঙ্গাকারীরা হাজার হাজার হিন্দুকে মেরেছে , তাদের সম্পদ লুঠ করেছে , মহিলাদের ধর্ষণ করেছে ও হাজার হাজার হিন্দুকে ধর্মান্তর করেছে । দাঙ্গায় নিহত হিন্দুর সঠিক সংখ্যা জানা যায় না । বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্য অনুসারে এই সংখ্যা কমপক্ষে তিন হাজার ও অধিকতম দশ হাজারের মধ্যে । অ্যানি বেসান্তের মতে , এই দাঙ্গায় নিহত , আহত , ধর্ষিতা ও ধর্মান্তরিত হিন্দুদের মােট সংখ্যা ১ লক্ষ । দাঙ্গার ভয়াবহতা ও নৃশংসতার কথা স্মরণ করলে এখনও মানুষের মধ্যে শিহরণ জাগায় , যদিও কমিউনিস্টরা সেই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা । করেছে । মালাপ্পুরম জেলায় এরনাড তালুকে ( মহকুমা ) উড়ানগাট্রিরি গ্রামে চেলিয়ার নদীর ধারে সেই পাথরের চট্টান আমি দেখে এসেছি যেখানে কমপক্ষে তিনশাে হিন্দুকে হত্যা করে এই চেলিয়ার । নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে । এখন জায়গাটা জঙ্গলে ঢাকা । ন্যূনতম স্মৃতিচিহ্নটুকুও রাখা হয়নি। শুধু স্থানীয়দের মুখে মুখে ঐ জায়গায় এই গণহত্যার কথা জানা যায় । আমি স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে একজন ছাগল চরানাে ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঐ দুর্গম জায়গায় যেতে পেরেছিলাম । ১৯২১ সালে দাঙ্গার । সময়ে চারদিক থেকে হিন্দুদেরকে ধরে এনে নদীর ধারে ঐ পাথরের উপর দাঁড় করিয়ে হত্যা করে ধাক্কা দিয়ে ঐ চেলিয়ার নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল । দাঙ্গাকারীদের কাছে বন্দুক প্রায় ছিল না , । তাই ছুরি বা ধারালাে অস্ত্র দিয়েই এই গণহত্যা . সম্পন্ন করা হয়েছিল । এলাকার সকলের কাছে শুনেছি এই নিহতদের মধ্যে দু’জন ব্রাহ্মণ ছিলেন — বিষ্ণু নাঙ্গুদ্রি ও পুরুষােত্তম নাম্বুদ্রি । সঠিক তারিখ জানা যায় না । এইরকম আরও তিনটি – গণহত্যার স্থান আমি দেখেছি । তারমধ্যে একটি । হল নিলামুর রাজপ্রাসাদের সদর দরজা ।
এইসব জায়গাগুলােই আমাকে যেতে হয়েছে । শুধু জনশ্রুতি ও প্রাপ্ত ইতিহাসকেনির্ভর করে , কারণ কোন স্থানেই এইসব গণহত্যার কোন স্মারক চিহ্ন বা বিবরণ দেওয়া কোন ফলক রাখা হয়নি । বামপন্থীদের কাজই হল মুসলিম নৃশংসতার সমস্ত । ঘটনাকে চাপা দেওয়া ও সমস্ত চিহ্নকে মুছে ফেলা ।
১৯২১ সালে আগস্ট মাসে এই মােপলা দাঙ্গা শুরু হয়ে ছয় মাস পর্যন্ত চলেছিল । তাই আমি কেরলের হিন্দুসংগঠনগুলিকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেছি যে , আগস্ট মাসে যে কোন একটি দিনকে মােপলা দাঙ্গা দিবস হিসাবে চিহ্নিত করে বর্তমান প্রজন্মের যুবক , কিশাের ও বালকদের নিয়ে ঐ দিনে ঐ গণহত্যার স্থানগুলিতে গিয়ে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাে এবং ধীরে ধীরে ঐ জায়গাগুলিতে ঘটনারবিবরণ দিয়ে ফলক লাগানাে । বেদনাদায়ক ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই চেষ্টা অতি ন্যূনতম এবং এটুকু করা উচিত বলে আমি মনে করি ।
এবার আসি মালাঙ্গুরমের বর্তমান অবস্থায় । বর্তমানে এই জেলার জনসংখ্যা ৪১ লক্ষ ( ২০১১ সেনসাস ) যার মধ্যে ৬১ শতাংশ মুসলিম । জেলার একটি বড় মহকুমা কেন্দ্র পােন্নানি । এখানে রমরম করে চলছে সরকার অনুমােদিত রেজিস্টার্ড ধর্মান্তকরণ কেন্দ্র । নাম মউনাতুল ইসলামা সভা । এটাও দেখে এসেছি একটি বিরাট শিবমন্দিরকে টিপুসুলতানের আক্রমণের সময় মসজিদে পরিণত করা হয়েছে । তার পাশেই গড়ে উঠেছে এই মউনাতুল ইসলামা সভা সংস্থাটি । বিশাল পরিসর , থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ এখানে ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষা , রীতি রেওয়াজ , ইতিহাস ও কলমা পড়ানাের ব্যবস্থা আছে । আমাদের বাংলার মতাে শুধু কলমা পড়িয়েই এখানে মুসলমান করা হয় না । কলমা পড়ানাের পর ছয় মাস থেকে দু’বছর পর্যন্ত ইসলামের প্রশিক্ষণ দিয়ে তবেই এখান থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয় । পুরুষ এবং স্ত্রী সকলের ধর্মান্তরের ব্যবস্থা এখানে আছে । এমনকি বিদেশ থেকেও মানুষকে এনে এখানে ধর্মান্তর করানাে হয় । একটি পরিসংখ্যানে দেখতে পাচ্ছি যে ২০০৮ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত , অর্থাৎ এক বছরে এই কেন্দ্র থেকে মােট ৭৮৩ জন অমুসলিমকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে । তাদের মধ্যে কেরল ৫৮৯ , কর্ণাটক ৮৬ , মহারাষ্ট্র ৪ , ওড়িশা ৩ , পশ্চিমবঙ্গ ২ এবং থাইল্যান্ডের ১৩৯ জন । এটি শুধুমাত্র সরকারি স্বীকৃত পােন্নানি ধর্মান্তর কেন্দ্রের পরিসংখ্যান । এরকম আরও তিনটি ধর্মান্তরকরণ কেন্দ্র চলছে বলে জানতে পেরেছি — মালাপ্পুরম শহর , মাঙ্গেরি এবং তিরুঅনন্তপুরমে ।
উত্তর কেরলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি । তুলনায় মধ্য ও দক্ষিণ কেরলে কম । কিন্তু এই উত্তর কেরলেই আর এস এসের সঙ্গে প্রতিদিন রক্তাক্ত সংঘর্ষ হচ্ছে সিপিএম – এর । পশ্চিমবঙ্গ , বিহার , আসাম , উত্তরপ্রদেশের মতাে ঘনঘন হিন্দু – মুসলিম সংঘর্ষ বা দাঙ্গা কেরলে হয় না । যদিও সেখানে বেশ কয়েকটি ইসলামিক সংস্থা আই এস আই এস – এর কাজে সক্রিয় , তবুও সাধারণ মুসলমানের আচার ব্যবহার বেশ খানিকটা শান্তিপূর্ণ বলেই আমার মনে হয়েছে । অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় । এর একটা কারণ এটাও হতে পারে যে সেখানকার বহু মুসলমান মধ্য প্রাচ্য ও আরব দেশগুলিতে কাজ করে । সেখানে তারা প্রচুর টাকা রােজগার করে কেরলে নিয়ে আসে বা পাঠায় । সেই টাকা দিয়ে মুসলিমরা সম্পত্তি কেনা , বাড়িঘর তৈরি করা ও ব্যবসাবাণিজ্য করায় লেগে থাকে । তাই রােজ রােজ ঝামেলা করার সময় তাদের নেই।কারণ যাই হােক না কেন , ফলটা খুব স্পষ্ট । উত্তর কেরলের ৭০ ভাগ ব্যবসাবাণিজ্য মুসলমানের হাতে চলে গেছে । কোঝিকোডের মতাে বড়শহরেও মুসলমানের দোকান থেকে জিনিস না কেনা বা মুসলিম হােটেল রেস্টুরেন্টে না খাওয়ার কথা হিন্দুরা চিন্তাও করতে পারে না । আমার অনুভুতি , সেখানে হিন্দুরা মনে মনে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে । ইসলামের এই প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা তারা ভাবতেও পারে না । উত্তর কেরলে সিপিএম ও আর এস এস সংঘর্ষে বনাম হিন্দু লড়াই চলছে । আর মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে কেরল দখল করে নিচ্ছে । বর্তমানে সমগ্র কেরলে হিন্দুর সংখ্যা কমতে কমতে ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে । মুসলিমের সংখ্যা হয়েছে ৫২ শতাংশ ।
কেরল বিশেষ করে মালাবারে এত মুসলিম হল কি করে তার একটু ঐতিহাসিক পটভূমি বলা দরকার । ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৯০ পর্যন্ত মহীশূরের নবাব হায়দার আলি ও তার পুত্র টিপু সুলতান বেশ কয়েকবার কেরলে দুটি রাজ্যের উপর আক্রমণ করেন ও অনেকটা সময় ধরে রাজত্ব করেন । এই দুটি রাজ্য ছিল কোচিন ও ত্রিবাঙ্কুর । এছাড়াও এরনাড প্রভৃতি স্থানে আরও ছােট ছােট রাজ্য ছিল । এই আক্রমণগুলির সময় বিশেষ করে টিপু সুলতান ব্যাপকভাবে হিন্দু মন্দির ধ্বংস , মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করা ও হাজার হাজার হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার কাজ শকরেছিলেন । তার রণকৌশল ছিল হিন্দু সমাজের সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের গায়ে হাত না দেওয়া । সমাজের মধ্যবর্তী অংশ নায়ারদের হত্যা করা ও সমাজের পশ্চাৎপদ অংশ এড়ােয়াদের ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করা । কৌশলটা খুবই কাজে লেগেছিল । নাম্বুদ্রিদের কথাকে হিন্দু সমাজ বেদবাক্যের মতাে পালন করত । কিন্তু তাদের গায়ে হাত না পড়ায় এই ইসলামিক আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তারা সমাজকে আহ্বান করলেন না । নায়াররা ছিল যােদ্ধা ও অত্যন্ত ধনী । তাদের উপর আক্রমণে এড়ােয়ারা এগিয়ে গেল না তাদের রক্ষা করতে । আর এভােয়াদের যখন ধর্মান্তরিত করা হতে থাকল তখন তা আটকাতে তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে কেউ নেই । সুতরাং এককথায় বলা চলে যে সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং শাস্ত্রচর্চার জন্য নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণরা যে শ্রদ্ধা ও মান্যতা সমগ্র হিন্দুসমাজের কাছ থেকে পেয়েছিলেন , তার মর্যাদা রাখতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন । বিধর্মী আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার যে ঐতিহাসিক প্রয়ােজন সেদিন ছিল , তা তারা দিতে পারেননি । তাই মালাবারে হয়ে গেল ইসলামীকরণ ।
কিন্তু ১৯২১ সালে মােপলা দাঙ্গার সময় মুসলমানরা নাম্বুদ্রিদেরকেও ছেড়ে কথা বলেনি । অনেক জায়গায় তারা নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদেরকে হত্যা করেছে । এইবার অন্ততঃ নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণরা তাদের ব্যর্থতা ও পরাজয়ের কথা অনুভব করতে পেরেছেন । বলতে ভুলে গিয়েছি , কেরলে সর্বজনে শ্রদ্ধেয় কমিউনিস্ট নেতা ই এম এস নাম্বুদিপাদের জন্মস্থানও এই মালাপ্পুরম জেলাতেই । যে মুহূর্তে আমি এটা জানতে পারলাম আমার মনে বিদ্যুতের চমক খেলে গেল । ঘাের অন্ধকার রাতে যেমন বিদ্যুৎ চমকে মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটা দেখা যায় , ঠিক তেমনি বাংলা ও কেরলে কমিউনিজমের সৃষ্টি প্রভাবের পিছনে আসল সত্যটা আমার মনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল । বাংলা ও কেরলের মিলটা দেখতে পেলাম আমি । পূর্ববঙ্গের অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালী উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যেমন ইসলামিক পাশবিকতার কাছে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অপমানিত ও পরাজিত হয়ে , বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে দোষারােপ করে মার্কসবাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে সেই অপমানবােধ পরাজয় ও আত্মগ্লানিকে নিজের কাছে থেকেই লুকাতে চেয়েছেন , ঠিক তেমনি কেরলে ই এম এস ও অন্য নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদেরকে মুসলমানের ঐ মার মার্কসবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে । নিজেদের পরাজয় ও সমাজরক্ষায় নেতৃত্বদানে ব্যর্থতা লুকাতে তারা মার্কসবাদের অজুহাত নিয়েছেন । তারই ফলে ঐ হায়দার আলি ও টিপু সুলতানের অত্যাচার । প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ এবং মােপলা দাঙ্গার আসল ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে তারা সমগ্র মানবসভ্যতার প্রচণ্ড ক্ষতি করে দিয়েছে । তাদের এই অপকর্মের জন্যই বিকৃত ইতিহাস আমাদের জাতির উপর চেপে বসে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে । এ ক্ষতি অপূরণীয় ।
আশ্চর্যের কথা যে, এই ব্যাপারে কমিউনিস্টদের সঙ্গে গান্ধীজীর প্রচণ্ড মিল। আর ততটাই অমিল ডঃ আম্বেদকর ও স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের সঙ্গে । ১৯২১ – এর সেই হিন্দু গণহত্যার পর গান্ধীজী মােপলাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সাহসী যুদ্ধের জন্য । গান্ধীজী বলেছিলেন, “ সাহসী ও ঈশ্বরভীরু মােপলারা তাদের ধর্মীয় কারণে যুদ্ধ করছে এবং যে পদ্ধতিতে যুদ্ধ করছে তাকে তারা ধর্মীয় পদ্ধতি বলে মনে করে । ” অর্থাৎ মােপলা মুসলমানদের এই হিন্দু গণহত্যাকে গান্ধীজী একটি শব্দেও নিন্দা না করে এটা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে স্বীকৃতি দিলেন । ডঃ বি আর আম্বেদকর গান্ধীর এই বক্তব্যের তীব্র সমালােচনা করে বললেন যে, গান্ধীর স্বপ্নের হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের জন্য এই মূল্য বড় বেশি ভারী হয়ে গেল । আর্য সমাজের স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের চেষ্টায় প্রায় দুই হাজার ধর্মান্তরিত মুসলমানকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল । তারই পরিণামে ১৯২৬ সালে ২৩ শে ডিসেম্বর আব্দুল রসিদ নামে এক ব্যক্তি স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দকে তাঁর আশ্রমে হত্যা করে । সেই হত্যাকারী আব্দুল রসিদকেও অহিংসার পূজারী গান্ধী একজন ধর্মভীরু মুসলমান ও তার ভাই বলে ঘােষণা করেছিলেন ।
একটি কথা উল্লেখ করা খুব দরকার যে প্রায় ছয় মাস এই একতরফা দাঙ্গা চলার পর ব্রিটিশরা নির্মমভাবে এই দাঙ্গা দমন করে । ব্রিটিশ সরকারী তথ্য অনুযায়ী এই দাঙ্গায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৩ জন নিহত ও ১২৬ জন আহত হয়েছিলেন । অন্যদিকেদাঙ্গাকারীদের মধ্যে ২৩৩৭ জন নিহত, ১৬৫২ জন আহত এবং ৪৫,৪০৪ জনকে বন্দী করেছিল ব্রিটিশ সরকার । এদের মধ্যে ২০ হাজারবন্দীকে আন্দামানে পাঠিয়ে দিয়েছিল । তার পরেই আর্য সমাজের দ্বারা এই শুদ্ধিকরণ ও হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল ।
মােপলা দাঙ্গার কিছু ইতিহাস আমার আগেই পড়া ছিল । এবারে আর একটু খুঁটিয়ে পড়লাম । স্বচক্ষে দেখে এলাম এলাকাগুলিকে । বর্তমানের উপর তার কতটা প্রভাব তা বােঝার চেষ্টা করলাম । এবং আমাদের বাংলার পরিস্থিতির সঙ্গে কেরলের পরিস্থিতির কতটা মিল বা অমিল তা বােঝার চেষ্টা করতে আমার এই কেরল সফর ।
আমার উপলব্ধি এককথায় , উত্তর কেরলের হিন্দুরা লড়াই ছেড়ে দিয়ে আগ্রাসী ইসলামের কাছে নতিস্বীকার করেছে , ফলে শান্তিপূর্ণভাবে উত্তর কেরলে ইসলামিকরণ চলছে । কিন্তু বাংলায় হিন্দুরা এখনও নতিস্বীকার করেনি । সচকিত ও সজাগ হয়ে প্রতিরােধের প্রস্তুতি করছে ।
পথপ্রদর্শক তপন ঘোষ
স্বদেশ সংহতি সংবাদ, মে ২০১৭