গোপাল চন্দ্র মুখার্জির(গোপাল পাঠাঁ) সাক্ষাৎকার।

ছবি: গোপাল চন্দ্র মুখার্জিভাস্কর্য

১৯৯৭ সালের ২৫শে এপ্রিল বিবিসি কে একটি সাক্ষাৎকার দেয় গোপাল চন্দ্র মুখার্জি(গোপাল পাঠাঁ)। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়ারের কাছে একটা ঘরে বসে বিবিসি রেডিও-র জন্য সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড কে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন গোপাল চন্দ্র মুখার্জি। ওই ঘরে বসে বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেডের সাথে এক ঘণ্টারও বেশি সময় কথা বলেছিলেন গোপাল মুখার্জী।

ওই সাক্ষাৎকারগুলোর মূল অডিও রেকর্ডিং এখন লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, সোয়াসের আর্কাইভে রাখা আছে।

সাক্ষাৎকারে গোপাল চন্দ্র মুখার্জি জানান,
ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে অশান্তি বাঁধতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা সব পক্ষেরই ছিল, তাই প্রস্তুতিও নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। গোপাল পাঁঠা ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময়ে থেকেই দলবল জোগাড় করে রেখেছিলেন, তাদের কাছে সেই সময় থেকেই অস্ত্র মজুত ছিল।

তবে ৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে “যে যেখান থেকে যা পেয়েছে, সে একখানা ছুরি-কাটারি কি তলোয়ার, বন্দুক, পিস্তল। আরও কিছু সিকিওর করা ছিল ৪২-র মুভমেন্টের সময়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন সৈন্যবাহিনী যখন কলকাতায় অবস্থান নিয়েছিল, তাদের কাছ থেকেও অস্ত্র কিনে রাখা হয়েছিল।

আড়াইশো টাকা দিলে একটা ৪৫ পিস্তল (পয়েন্ট ৪৫ পিস্তল) আর একশো কার্টিজ দিয়ে দিত। এক বোতল হুইস্কি কিনে দিলে একটা পিস্তল আর একশো কার্টিজ দিয়ে দিত। এইভাবে সিকিওর করেছি।

১৬ই অগাস্ট, যেদিন কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, সেদিন তিনি বিকেল তিনটে পর্যন্ত বৌবাজার এলাকায় দাঙ্গা থামানোর কাজ করছিলেন। তখনই তার কাছে খবর আসে যে তার নিজের পাড়াতেও হামলা হয়েছে।

আমি ওখানে থাকার সময়ে আমার এই লোকালিটি থেকে খবর গেল যে ওখানে অ্যাটাক করেছে চাঁদনির (চাঁদনি চক এলাকা) মুসলমানরা। এখানে মুসলিম এলাকা একটা আছে। আমি বললাম তোমরা এখানে দায়িত্ব নিয়ে থাকো। আমি আমার এলাকায়, আমার পাড়ায় কী হচ্ছে সেটা দেখি।

সেখানেও থামানো দরকার, কারণ আমার এখানে কয়েকটা বাড়ি আছে, একটা বাড়িতে একটা মুসলিম মেস ছিল তাতে সাড়ে তিনশো চারশো মুসলমান – এই চাঁদনি বাজারের কর্মচারী তারা। ৩২ এর এক মলঙ্গা লেন – ওই বাড়িটাতে ভর্তি মুসলমান। তার পাশে একটা বাড়ি ছিল স্যালভেশন আর্মির – সে বাড়িটাও খালি ছিল, তাতেও ভর্তি মুসলমান।

নিজের পাড়ায় এসে দেখেন যে তার বাড়ির দরজার গোড়াতেই জঞ্জাল জড়ো করে আগুন লাগিয়েছে দাঙ্গাকারীরা, আর সামনে একটা পানের দোকান লুঠ হচ্ছে।

আমার হাতে একখানা সোর্ড ছিল, সেই সোর্ডটা দিয়ে যে লুটেরা ছিল তাকে একটা কোপ দিই। সে কাটা পড়ে। তারপরেই কাঠের পিলার ছিল, পিলারে লেগে সোর্ডটা ভেঙ্গে যায়। তখন একগাছা স্টিক নিয়ে তাদের তাড়া করি। তারা পালিয়ে যায়।

সেদিন বিকেলে কিছু মুসলমান বন্ধুকে ডেকে তিনি বলেছিলেন যে তার এলাকায় যেন কোনও অশান্তি না হয়। চেয়েছিলেন দাঙ্গা থামাতেই।

এখানে হিন্দু-মুসলিম যেমন ভাই-ভাই আছি, থাকব। যেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে হোক। ইন দ্য মিন টাইম কড়েয়ার দিক থেকে একটা গ্রুপ তাসা বাজিয়ে এসে ময়দানের (সেই সময়ের ওয়েলিংটন স্কোয়ার) মধ্যে ঢুকেছে। আমি ওদেরকে ডাকলাম। ডেকে বললাম এদেরকে প্রতিরোধ কর, বাধা দাও। যে গণ্ডগোলগুলো করো না, তোমরা ফিরে যাও।

সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল, সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। তবে মাথায় তখনও চিন্তা ছিল যে এলাকায় এত মুসলমান মানুষ রয়েছেন, তাদের ওপরে কেউ হামলা না করে দেয়।

পাড়ার মুসলমানদের উদ্ধার তার দলের ছেলেদের দিয়ে পাহারা দিয়ে তিনি কাছের বৌবাজার থানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

১৬ই অগাস্ট বিকেলে যে মুসলিমদের দলটি ওয়েলিংটন স্কয়ারের দিকে এসেছিল এবং যাদের বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই দলটি আবারও ফিরে এসেছিল পরের দিন, ১৭ তারিখ।

পাড়ায় তখন টহলদার পুলিশ বাহিনী ছিল, তাদের সঙ্গে খাতিরও ছিল আমার। টহলদার বাহিনীকে বলেছিলাম যাতে ওই জমায়েত আটকানো হয়।

তখন আমার কাছে দুটো ৪৫ পিস্তল – আমেরিকান, সাঁটানো কোমরে। কারণ বলা যায় না তো কী করবে না করবে। দুটো পিস্তল দুপাশে সাঁটানো.. লোডেড। আমি ভেতরে গেছি। আর আমার লোকাল ছেলেরা বলছে দাদা যাবেন না। তা সত্ত্বেও আমি গেছি।

আমার সঙ্গে অনেক ছেলে গেছে, তারা ওয়াচ করছে যে আমাকে ঘিরছে। তখন আমিও লক্ষ্য করলাম যে আমাদের কথা শুনছে না ওরা সারাউন্ডিং ঘিরছে। আমি গুলি চালাতে পারতাম, কিন্তু একটা লাইফের দাম আছে। একটা লাইফ নিতে বেশি সময় লাগে না, কিন্তু একটা লাইফকে বাঁচাতে অনেক সময় লাগে।

আমি সিধে কাওয়ার্ডের মতো পালিয়ে গেলাম। লোকজন যাতে না মরে যার জন্য আমি ব্যাক করলাম।

আমি সব লোকাল ছেলেদের কল করে বললাম যে দেখো মারছ বা মারবে, ওরাও যা করছে তোমরাও তাই করবে। তবে এখন দেখছি বর্বরতার দ্বারাই বর্বরতা দমন হবে। সুতরাং যদি কানে শোন যে একটাকে মেরেছে, তোমরা ওয়ান টু টেন করবে, তোমরা দশটাকে মারবে। তবেই এটা বন্ধ হবে। মারবে মানে আধমরা করবে না একদম খতম করবে।

কে কত মেরে এসেছে, সেই লিস্ট রাখিনি বা জানতে চাইনি। আমি অর্ডারটা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।

কংগ্রেস লিডাররা আমার কাছে আসে, যে গোপাল মান-ইজ্জত যাবে, তুমি কিছু যন্ত্রপাতি গান্ধীজীর কাছে জমা দাও।

এদের কথা এড়াতে পারলুম না, আমি বললাম আচ্ছা চলুন। যাওয়ার পর .. কেউ একটা ভাঙ্গা পিস্তল দিচ্ছে, কেউ একটা অকেজো রিভলভার দিচ্ছে, কেউ একটা গান দিচ্ছে, কেউ ছুরি দিচ্ছে দুখানা। তারপর আমার ডাক হয়েছে, আমি গেলাম।

ইন্টারপ্রেটার ছিল নির্মল বোস (অধ্যাপক নির্মল বসু, মি. গান্ধীর সহকারী) বলল যে গোপাল তোমার কাছে যে অস্ত্রপাতি আছে সব গান্ধীজীকে দাও। তখন আমি বললাম যে যখন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসটা হলো, তখন গান্ধীজী কোথায় ছিলেন! যে অস্ত্র দিয়ে মা বোনের ইজ্জত রক্ষা করেছি, মহল্লা রক্ষা করেছি, সে অস্ত্র আমি একটাও জমা দেব না এবং একটা সূচ দিয়েও যদি কাউকে মেরে থাকি সেটাও জমা দেব না।

সূত্র- বিবিসি নিউজ বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *