
গত ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি গোলাপী রঙের ব্যানার আপলোড করে ক্যাপশনে লিখেছেন, “কালকে নাকি TSC তে TMD আয়োজন হবে? Total Mishti Distribution”.
ব্যানারে ইংরেজিতে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, “Total Mishti Distribution”। ব্যানারের মাঝখানে শেখ হাসিনার কয়েকটি স্ক্যাচ রয়েছে যেখানে, তাকে ‘রাক্ষসী’ আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই পোস্টে মোট ৪৪ জন ব্যক্তি রিয়েকশন দিয়েছেন। এরমধ্যে ২৮টি আইডি থেকে ‘লাভ’ এবং ১০টি আইডি থেকে ‘কেয়ার’ রিয়েক্ট দেয়া হয়েছে।
এই ৩৮টি আইডির মধ্য থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ১০টি আইডিতে গিয়ে TMD লিখে সার্চ দেয়ার পর ৭টিতে এই শব্দটি ব্যবহার করে পোস্ট পাওয়া গেছে। বাকি ৩টি আইডি ‘লকড’ থাকায় সার্চে কোন রেজাল্ট আসেনি।

৭টি আইডির মধ্যে একটিতে গত ৭ মে তারিখে একটি পোস্ট ছিল, “Call for TMD.”। এই পোস্টে অনেকে কমেন্ট করে TMD এর অর্থ জানতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ কমেন্টে অক্ষর তিনটির পূর্ণরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।
কমেন্ট থ্রেডে একজন শব্দটির সম্ভাব্য পূর্ণরূপ লিখেছেন, “’Total Malaun Death’ Maybe.”। আরেকজন কমেন্ট করেছেন, “Meaning ki?”; উত্তরে অন্য আরেকজন লিখেছেন, “total malaun death”.

৭টি আইডির আরেকটিতে একাধিকবার TMD যুক্ত পোস্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর এক পোস্টে লেখা হয়েছে, “শুক্রবার রিমাইন্ডার: হিন্দুত্ববাদ নিপাত যাক, বাংলাদেশ মুক্তি পাক। বিদ্র: সনাতন ধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ ভিন্ন জিনিস। #TMD (উগ্রদের ক্ষেত্রে)”
অর্থাৎ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির পোস্টে যারা ‘লাভ’ ও ‘কেয়ার’ রিয়েকশন দিয়েছেন বেশিরভাগই ‘TMD’ এর অর্থ বুঝে রিয়েকশন দিয়েছেন এবং অতীতে তারা নিজেদের প্রোফাইলেও এই হ্যাশট্যাগ বা শব্দটি ব্যবহার করে পোস্ট করেছেন।
TMD: Total Malaun Death (হিন্দুদের সম্পূর্ণরূপে হত্যা/গণহত্যা)
বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যার আহ্বান জানিয়ে #TMD বা ‘Total Malaun Death’ হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইনটি কবে থেকে চলছে তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দ্য ডিসেন্ট দেখতে পেয়েছে এ সংক্রান্ত পোস্ট ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম শুরু হয়।
ফেসবুকে বছর ভিত্তিক সার্চ করে এবং ‘Who Posted What’ নামক একটি সার্চ টুল ব্যবহার করে নিশ্চিত হওয়া গেছে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের আগে এই হ্যাশট্যাগে কোন পোস্ট বাংলাদেশ থেকে করা হয়নি।
মূলত জুলাই অভ্যুত্থান পরপর হিন্দু ধর্মগুরু– যিনি ইসকনের মহাপ্রভু ছিলেন– চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গত বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতারের পর চট্টগ্রামে হিন্দু কয়েকটি সংগঠন বিক্ষোভের ডাক দেয় এবং আদালত ঘেরাও করে।
২৬ নভেম্বর আদালত চিন্ময়ের জামিন না নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর হুকুম দিলে বিক্ষোভকারীরা আদালত সড়কে রাখা বেশ কিছু মোটরসাইকেল ও যানবাহন ভাঙচুর করে। এরপর আদালতের সাধারণ আইনজীবী ও কর্মচারীরা মিলে তাদের ধাওয়া করে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে রঙ্গম কনভেনশন হল সড়কে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখে যাদেরকে হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাদের বেশ কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতারকৃত বেশিরভাগ আসামীও হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
এই ঘটনার পরের কয়েকদিন মূলত TMD হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করে বিভিন্ন বেনামি আইডি থেকে প্রথম হিন্দুদের গণহত্যা করার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট করা শুরু হয়।
আলিফ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যখন সামাজিক মাধ্যমে অনেকে সোচ্চার হন তখন এই হ্যাশট্যাগটি জনপ্রিয় হতে থাকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলিফ হত্যার ৪ দিনের মাথায় ৩০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করেছেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ব্যবহারকারী। অবশ্য এই হ্যাশট্যাগের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ভারত থেকেও পোস্ট করা হয়েছে, যেখন ভারতীয় কয়েকটি মিডিয়াতে এই হ্যাশট্যাগ নিয়ে খবর প্রচারিত হয়েছিল।
২০২৪ এর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় ডানপন্থী মিডিয়া আউটলেটগুলোর বেশ কয়েকটিতে এই হ্যাশট্যাগ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
যেমন, ৩০ নভেম্বর ‘হিন্দু পোস্ট’ এর শিরোনাম ছিলো, “Bangladesh: Islamists make genocide calls against Hindus with religious slurs, trend #TMD or ‘Total Malaun Death’ on SM platforms to rally extremists”.
একইদিনে ‘অপইন্ডিয়া’ নামক ওয়েবসাইটেও একই শিরোনাম খবরটি প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি এক্স এবং ফেসবুকেও ভারতীয় অনেকে বাংলাদেশে TMD হ্যাশট্যাগের ব্যবহার করে হওয়া পোস্টগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পোস্ট দিয়েছেন।
চলতি নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে #TMD লিখে সার্চ করে মোট ২ লক্ষ ২৮ হাজার পোস্ট ফেসবুকে এই ট্যাগের অধীনে রয়েছে বলে দেখা গেছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ ভারত থেকে পোস্ট করা।
মিয়াজী নিখোঁজের ঘটনায় TMD হ্যাশট্যাগ
আলিফ হত্যাকাণ্ডের রেশ কেটে যাওয়ার পরও বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার হয়েছে হ্যাশট্যাগটির। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরে ১৩ বছর বয়সী একজন মাদ্রাসাছাত্রীকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবক জয় কুমার দাস কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগ এবং একই জেলায় মুফতি মোহেব্বুল্লাহ মিয়াজীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ইস্কনবিরোধী প্রচারণা সামাজিক মাধ্যমে গতি পেলে হ্যাশট্যাগটি নতুন করে প্রচারণায় আসে।

দ্য ডিসেন্ট মিয়াজী ইস্যুতে TMD হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন চালানো কয়েক ডজন বেনামী ফেসবুক প্রোফাইল ও পেইজ চিহ্নিত করেছে। মুফতি মোহেব্বুল্লাহর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে তার ছোট ছেলে মোহাম্মাদুল্লাহর বরাতে আতাউর রহমান বিক্রমপুরীসহ অন্যরা ‘ইসকন কর্তৃক গুমের ঘটনা’ হিসেবে প্রচারণা শুরু করার পর ওইসব প্রোফাইল থেকে ব্যাপকভাবে TMD হ্যাশট্যাগে বিভিন্ন কন্টেন্ট প্রচার করা শুরু হয়। এসব কন্টেন্টের মধ্যে টেক্সট, ছবি, ভিডিও, গান এবং বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য রয়েছে। কিছু আইডি ও পেইজ থেকে আতাউর রহমান বিক্রমপুরীর একটি বক্তব্যের ক্লিপ পোস্ট করে #BanISCKON এবং #TMD হ্যাশট্যাগ দেয়া হয়েছে। আরও কিছু পোস্টে মোহেব্বুল্লাহর নিখোঁজের ঘটনায় ইসকনকে দায়ী করে তার ছোট ছেলে ও বিক্রমপুরীর বক্তব্যের ভিডিও পোস্ট করে ‘Total Malaun Death’ লিখে TMD হ্যাশট্যাগ দেয়া হয়েছে।
“আরেকটি নোয়াখালী দরকার”
TMD হ্যাশট্যাগটির সাথে ‘নোয়াখালীর ঘটনা’ ‘১৯৪৬ এর নোয়াখালী’ ইত্যাদি নানান ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ করে ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ এবং ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’র রেফারেন্স টানা হয়েছে, এরকম অন্তত দুই শতাধিক পোস্ট পর্যবেক্ষণ করেছে দ্য ডিসেন্ট।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট অল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ আলাদা ভূখণ্ডের দাবিতে সমগ্র ভারতবর্ষে হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয়। এ কর্মসূচীটির নাম দেওয়া হয় ডাইরেক্ট একশন ডে। এদিন কর্মসূচী পালনকালে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে দাঙ্গা বাঁধে; এতে উভয়পক্ষে কয়েক হাজার মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলে কথিত আছে।
কলকাতা দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ওই বছরের ১০ অক্টোবর তৎকালীন নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানায় হিন্দুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে এটি বর্তমান লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। অক্টোবর-নভেম্বরে এর তীব্রতা থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই দাঙ্গা। এতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বহু লোক হত্যার শিকার হন।
সালমান ফারসি নামক এক আইডি থেকে একটি ফেসবুক পোস্টে হাতে ধারালো অস্ত্র এবং মাথায় সাদা টুপি পরা দুই ব্যক্তির কার্টুন ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “আরেকটি নোয়াখালী দরকার #TMD”।

ইবতিহাজ তাহসিন নামের একটি আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে, “Dont’ ask your নোয়াখাইল্যা দাদা, What did he do in 10th October of 1946.”
TMD এর সাথে নোয়াখালী দাঙ্গাকে সম্পর্কিত করে তৈরি করা পোস্টারসহ ঢাকার শাপলা চত্বরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে গত ২৪ অক্টোবর পোস্ট করেছেন এক তরুণ। মাজহারুল ইসলাম সজিব নামের ওই তরুণ তার একটি ব্যানারে লিখেছেন, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে TMD করুন (‘Total Mishti Distribution”।
তার একটি ব্যানারে TMD এর ব্যাখ্যা হিসেবে ব্রাকেটে ‘Total Mishti Distribution’ লিখলেও আরেকটি ব্যানারে তিনি নোয়াখালী দাঙ্গাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

মাজহারুল ইসলাম সজিব ৩০ অক্টোবর তার ফেসবুকে নিজের কিছু ছবি পোস্ট করেছেন যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে তিনি মুখে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় কোথাও রাস্তায় বের হয়ে মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করছেন। পোস্টটিতে তিনি TMD হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে মাজহারুল ইসলামের সাথে দ্য ডিসেন্ট এর পক্ষ থেকে মেসেঞ্জারে টেক্সট দেয়া হলে তিনি ‘সিন’ করেছেন তবে কোন উত্তর দেননি।
TMD এর প্রচারে ছদ্মবেশ ধারণ
এই প্রতিবেদনের একদম শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণের পোস্ট করা একটি ব্যানারের কথা বলা হয়েছে যেখানে লেখা ছিল, “Total Mishti Distribution” যাকে সংক্ষিপ্ত করলে TMD হয়।
Total Mishti Distribution নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে যেটি গত কয়েক মাস ধরে সক্রিয় থাকলেও গত ৩০ অক্টোবর গ্রুপটি প্রথমে ‘Pause’ করা হয়। মূলত মোহেব্বুল্লাহ মিয়াজীর নিখোঁজের ঘটনায় গ্রুপটিতে করা TMD হ্যাশট্যাগযুক্ত এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যার আহ্বান সংক্রান্ত কিছু পোস্টের স্ক্রিনশট সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং এর প্রেক্ষিতে সমালোচনাও শুরু হয়। এরপরই গ্রুপটি ‘Pause’ করা হয়।
এর মধ্যে দ্য ডিসেন্ট গ্রুপটির পেছনে কারা আছে অনুসন্ধান শুরু করলে প্রথমে এটির ৩জন এডমিনের দুইজন নিজেদেরকে গ্রুপ থেকে সরিয়ে নেয়। এবং ৩ নভেম্বর বিকালে এই প্রতিবেদন লেখার সময় লক্ষ্য করা যায়, গ্রুপটি ডিলিট করে দেয়া হয়েছে।
দ্য ডিসেন্ট এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, Total Malaun Death- TMD এর প্রচারের জন্য ছদ্মবেশ হিসেবে অনেক সময় ‘দ্ব্যর্থবোধক’ অন্য কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে দুটি হলো, Total Mishti Distribution (TMD) এবং Total Meat Distribution (TMD)।
Total Mishti Distribution TMD নামক গ্রুপটিতে অসংখ্য পোস্ট এমন দেখা গেছে যেখানে প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু গণহত্যার আহ্বান বা প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
যেমন, একটি পোস্টে ‘ফালাও মালুর কল্লা’ লেখা একটি মিম শেয়ার করে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে “#TMD on loading”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ অক্টোবর Total Mishti Distribution শীর্ষক ব্যানারে মিষ্টি বিতরণ করা হয়; ওই ব্যানারে শেখ হাসিনার ‘রাক্ষসী’ ছবি ব্যবহার করা হয়েছে এবং পুরো ঘটনাটিকে ‘শেখ হাসিনার অসুস্থতা উপলক্ষে মিষ্টি বিতরণ’ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।
কিন্তু দ্য ডিসেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এই মিষ্টি বিতরণ কর্মসূচির আয়োজক অন্তত ২জনকে চিহ্নিত করেছে, যারা TMD হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে হিন্দুবিদ্বেষী কন্টেন্ট ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।
আয়োজকদের একজনের নাম মাহির রাকিন। তিনি ঢাবির দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। চলতি বছরের ২১ আগস্ট তার ওয়ালে ৩ সেকেন্ড এর একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন ‘TMD’। শেয়ার করা ভিডিওটি একটি ফিল্মের দৃশ্য যেখানে ক্লাসরুমে থাকা এক ছাত্রকে আরেক ছাত্র ধমকের সুরে বলছে, ‘চুপ মালাউন’।
১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ফেসবুক পেইজের একটি পোস্ট শেয়ার করে ক্যাপশনে রাকিন লিখেছেন, “TMD done”। আওয়ামী লীগের পেইজের পোস্টটিতে লেখা ছিল, “সেনাবাহিনীর গুলিতে গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাহসী কর্মী দীপ্ত সাহা শহীদ হয়েছেন”। সাথে দীপ্তর মরদেহের একটি ছবিও পোস্ট করা হয়েছে।

গত ৭ জুন মোস্তাকিম আহমেদ নামের এক বুয়েট শিক্ষার্থী কোরবানির পশু জবাইয়ের পর পোশাকে রক্ত মাখা ও হাতে ছুরি ধরা এক ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছেন এমন একটি ছবি আপলোড দিয়ে লিখেন One day after real TMD insha Allah অর্থাৎ একদিন বাস্তবে TMD ঘটানোর পর ইনশাআল্লাহ। এই পোস্টটি দেওয়ার পর সমালোচনার মুখে পড়েন ওই বুয়েট শিক্ষার্থী। পরে তিনি এর ব্যাখ্যা দেন তিনি এটা দ্বারা টোটাল মিট ডিস্ট্রিবিউশন বুঝিয়েছেন। তখন তার সমর্থনে আরও বেশ কিছু আইডি থেকে একই ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ‘who posted what’-এ কীওয়ার্ড সার্চ করে দেখা যায় জুন মাস থেকেই TMD’র অর্থ টোটাল মিট ডিস্ট্রিবিউশন তথা সম্পূর্ণ মাংস বিতরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন সময়। তবে ইস্কনকে নিষিদ্ধ করার দাবি সংবলিত বিভিন্ন পোস্টে হ্যাশট্যাগটির সাথে এই ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
ঢাবিতে TMD এর আয়োজক কারা?
৩০ অক্টোবর ঢাবিতে Total Mishti Distribution ব্যানারে মিষ্টি বিতরণের আয়োজনকারী অন্তত ৩জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য ডিসেন্ট। তাদের সবার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে তারা তিনজনই দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে TMD ক্যাম্পেইন করে আসছেন।
এদের একজন হলেন রুবায়েত ইসলাম রাফি। তিনি ঢাবির রোবটিক্স এন্ড মেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২৩-২৪ ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
রাফির কাছে জানতে চাওয়া হয় TMD হ্যাশট্যাগটি দিয়ে কী বুঝানো হয়? জবাবে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অসুস্থ হওয়ার খবর বের হওয়ায় তারা এই মিষ্টি বিতরণের আয়োজন করেছেন। তিনি দাবি করেন এই হ্যাশট্যাগটির অর্থ মিষ্টি বিতরণই বুঝায়।
এটির আর কী কী অর্থ আছে জানতে চাইলে বলেন, ‘টোটাল মুসলিম ডেথ’ও হইতে পারে। আবার আরাকানে যখন রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়ে গেল তখন মানুষ এটাও মিন করেছে যে, TMD মানে ‘টোটাল মগ ডেথ’।

আলাপের এক পর্যায়ে রাফি বলেন, “যারা TMD বলতেছে তাদের মধ্যে যেমন উগ্রপন্থী আছে, যারা এর বিরোধিতা করতেছে তাদের মধ্যেও ইস্কনপন্থী আছে। এডভোকেট (আলিফ) যখন হত্যার শিকার হইলো গত বছর এবং এটা যখন ইস্কন সমর্থিত মানুষদের দ্বারা হইলো এবং এটার কোন বিচার হইলো না, এটা যখন সামনে আগাইলো না, এই যে একটা ক্ষোভ, এই ক্ষোভের বশবর্তী হইছিলো কিন্তু নভেম্বর মাসে। ইভেনচুয়ালি TMD আসলো। এটা আপনাদের কাছে নিউ মনে হইতেছে, কিন্তু এটা নিয়ে নিউজও হইছিল গত বছর। রিপাবলিক বাংলা এটা নিয়ে একটা নিউজ করছে যেটা ইস্কনপন্থীরা শেয়ার দিছিল। এর কারণে যারা TMD ব্যবহার করছিল তারা আরও ক্ষেপে গেছিল। তাদের লজিক হইলো যারা TMD বলতেছে তারা তো কাউকে মারে নাই, কিন্তু ইস্কন তো একজনকে মেরে ফেলছে। এই ইস্যুগুলার কারণে জিনিসটা আরও বেশি ব্যবহার হইছে।”
রাফিকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কি এই ক্ষোভ থেকেই TMD ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়েছেন কিনা? জবাবে তিনি না বলেন।
“আমি কেন বলতেছি মানুষকে বারবার, মানুষ যেন ওই অর্থে ব্যবহার করা থেকে ফিরে আসে। আমি তো সরাসরি গিয়ে তাদেরকে মানা করতে পারবো না। আমি তাদেরকে এদিকেই আহ্বান জানাইতেছি যে, তোমরা কোন কমিউনিটিকে টার্গেট কইরো না”, বলেন রাফি
তার প্রশ্ন, “যারা TMD বলতেছে তারা কিন্তু এখনও কাউকে মারে নাই, তাদের বলাটাই যদি দোষের হয় আর যারা (ইস্কন) কোন হ্যাশট্যাগ দেয়নি কিন্তু অলরেডি মারতেছে। তাহলে প্রশ্ন হইলো কে বেশি খারাপ?
আয়োজকদের আরেকজন হচ্ছেন দর্শন বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাহির রাকিন। রাকিন তার ফেসবুক আইডিতে নিয়মিত TMD হ্যাশট্যাগে বিভিন্ন কিছু পোস্ট করেন।
মাহির রাকিনের কাছে TMD অর্থ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন এটা দিয়ে The Mollah Darbar বুঝানো হয়। তিনি বলেন, “আমরা অনলাইনে একদল মানুষ সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের দুর্ভোগ নিয়ে এক্টিভিজম করি। মানুষকে সচেতন করা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। ভারতে মুসলমানদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা কিছু এক্টিভিজম করলে সেটা ভারতীয় সাংবাদিক ময়ূখের নজরে আসে। সে দাবি করে আমরা TMD দিয়ে Total Malaun Death বুঝাইছি এবং আমরা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করছি। আমরা এটাকে সার্কাজম হিসেবে গ্রহণ করি এবং এটা নিয়ে মিম বানাই। আমরা দেখাতে চাই যে, তারা আমাদের যেভাবেই ফ্রেম করুক না কেন আমরা সেটা কেয়ার করিনা।”
তিনি আরও বলেন, “হাসিনা যেমন শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলার পর তারা নিজেদের রাজাকার বলা শুরু করেছে, TMD হ্যাশট্যাগের বিষয়টিকে আমরা সেভাবে গ্রহণ করেছি।”
নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে “চুপ মালাউন” বলা ভিডিওটি শেয়ার করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, কোন কনটেক্সটে তিনি এটি শেয়ার করেছিলেন তা এখন তার মনে নাই।
ঢাবির TMD মিষ্টি বিতরণের আরেকজন আয়োজক মো. সোলায়মান মিয়া; যার ফেসবুক আইডির নাম ডি কে সোলায়মান; যিনি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছেন। তার প্রোফাইলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রদলের কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। দ্য ডিসেন্ট নিশ্চিত হয়েছে তিনি ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রদলের আহ্ববায়ক কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন।
এই তিন আয়োজকের মধ্যে সোলায়মান সবচেয়ে TMD হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন তার ফেসবুক প্রোফাইলে। তার কাছে TMD হ্যাশট্যাগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ব্যঙ্গাত্মকভাবে নানান কথা বললেও দ্য ডিসেন্ট এর কোন প্রশ্নের উত্তর দেননি।

TND গ্রুপ থেকে TMD
অনুসন্ধানে জানা গেছে, TMD হ্যাশট্যাগটি মূলত The Nawabi Darbar সংক্ষেপে TND নামের একটি সিক্রেট ফেসবুক গ্রুপ থেকে শুরু হয়। The Nawabi Darbar গ্রুপের মেম্বার ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গ্রুপটি ৪/৫ বছর আগে খোলা হয়। এই গ্রুপে মূলত মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশেষ করে সুলতানী আমলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। গ্রুপের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শাহরিয়ার হালিম নামের লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশি এক যুবক। এই গ্রুপের আরেক সক্রিয় আইডি ছিল হাসান ইফতেখার। এই গ্রুপটির কিছু সদস্যের দ্বারাই গত বছরের নভেম্বরে TMD বা Total Malaun Death আইডিয়াটি সামনে আনা হয়। তবে Total Malaun Death শব্দগুচ্ছটি বেশি দৃষ্টিকটু এবং সরাসরি এটির ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় The Nawabi Darbar এর সাথে যুক্তরাই পরবর্তীতে TMD-কে একটি ছদ্মনাম দেন যা হচ্ছে ‘Total Misti Distribution TMD’। এরপর এই নামেই ফেসবুকে গ্রুপ খোলা হয় এবং TMD হ্যাশট্যাগের বিভিন্ন হিন্দুবিদ্ধেষী এবং হিন্দুদের গণহত্যার আহ্বান সম্বলিত নানান পোস্ট শেয়ার করা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর বিকালে ফেসবুক গ্রুপটি ডিলিট করার আগে এটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭০০ এর কিছু বেশি।

শাহরিয়ার ও ইফতেখারের আইডিতে TMD হ্যাশট্যাগের বেশ কিছু পোস্ট দেখতে পাওয়া যায় (ইফতেখারের আইডিতে ৩০টির বেশি, শাহরিয়ারের আইডিতে ১৬টি)। এই দু’জনের TMD হ্যাশট্যাগযুক্ত নানান পোস্টে রিয়েকশন দিয়ে বা শেয়ার কিম্বা কমেন্ট করে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে ঢাবিতে ৩০ অক্টোবর TMD ব্যানারে মিষ্টি বিতরণের আয়োজকবৃন্দ ডি কে সোলায়মান, রোবায়েত ইসলাম রাফি, মাহির রাকিন, শাপলা চত্বরে TMD পোস্টার নিয়ে পোজ দেয়া নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা মাজহারুল ইসলাম সজিবসহ আরও বেনামি বেশ কিছু আইডিও এবং পেইজকে।
প্রচারকারীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য
TMD হ্যাশট্যাগে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কন্টেন্ট প্রচারকারী অন্তত ৫০টি স্বনামী ও বেনামী আইডিতে পোস্ট করা কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করেছে দ্য ডিসেন্ট। এতে পোস্টকারীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। যেমন, এসব আইডিতে আল কায়েদার সাবেক নেতা ওসামা বিন লাদেন, জেএমবির সাবেক নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, হোলি আর্টিজানে হামলাকারী নর্থ-সাউথ শিক্ষার্থী নিবরাস ইসলামের ছবি শেয়ার করে ইতিবাচক কথা লেখা, তাদেরকে ‘নেতা’ হিসেবে সম্বোধন করা, আমেরিকার টুইন-টাওয়ারে হামলা (৯/১১) উদযাপন, তালেবান ও আল-কায়দার পক্ষে প্রচারণা করতে দেখা গেছে।
TMD হ্যাশট্যাগে আসলে কী প্রচার করা হয়?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের আশ্রয় নেয়ার পর যখন ভারতীয় মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা’ চলছে বলে ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইন শুরু হয় প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের অনলাইন জগতে শুরু হওয়া TMD হ্যাশট্যাগটি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় এই বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। TMD হ্যাশট্যাগের অধীনে করা বহু পোস্টে সরাসরি হিন্দুদের ওপর গণহত্যা চালানোর আহ্বান বা প্রত্যাশা প্রকাশ করা হয়। এই ধরনের আহ্বান যুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট প্রচার করতে দেখা গেছে হ্যাশট্যাগটিতে।
এসব কন্টেন্টের মধ্যে রয়েছে কোন সংবাদাধ্যমের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট, মিম ছবি, কোন ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও, কারো বক্তব্য, কার্টুন ছবি, ভিডিও গেমস এবং গান।
একটি ভিডিও গান এই ধরনের আইডিগুলোতে শেয়ার হতে দেখা গেছে। গানটির কয়েক চরণগুলো এমন, “বাংলার মোল্লা, ফালাও মালুর কল্লা। মালাউন করবে পলায়ন… মালাউন খেদাও, দেশ বাঁচাও। মালাউন *দলে বাঁচবে দেশ।”
একটি ভিডিওতে সুরে সুরে এই গানটি বাজছে আর স্ক্রিনে নানান ধরনের ছবি ও ভিডিও ক্লিপ ভেসে উঠছে। এর এক অংশে দেখা যায়, একজন যুবককে কুড়াল দিয়ে একটি তরমুজ কাটছে। এসময় তরমুজের কিছু অংশ ছিঁটকে যুবকের মুখে গিয়ে পড়ে। এরপর তাকে একটি আরপিজি তাক করতে দেখা যায়।
দ্য বেঙ্গলি সাইবার মুজাহিদ নামের একটি পেইজ থেকে হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে যেখানে দেখানো হয়, স্কুলের একজন বাচ্চা আরেক বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করছে Are you Hindu? (তুমি কি হিন্দু?) জবাবে যখন অন্য বাচ্চাটি জানায় সে হিন্দু, তখন প্রথম বাচ্চাটি তাকে একটি কাঠের বন্দুক দিয়ে গুলি করার ভঙ্গি করে। পোস্টটির ক্যাপশন ছিল #TMD from childhood অর্থাৎ ‘শিশুকাল থেকেই টিএমডি’।
বেশ কিছু কার্টুন ও মিম প্রচার করা হয়েছে হ্যাশট্যাগটি দিয়ে, যেগুলোতে দেখানো হয়েছে মুসলমানরা হিন্দুদেরকে মারছে। এমনই একটি কার্টুনে দেখা যায়, চুল দাঁড়ি লাল করা দু’জন পুরুষ একটি বাঁশে করে একজন মৃত ব্যক্তিকে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যার কপাল হিন্দু ধর্মালম্বীদের ব্যবহার করা তিলক চিহ্ন রয়েছে।
আরেকটি এমন কার্টুনে দেখা যায় মাথায় টুপি ও মুখে লম্বা লাল দাঁড়িওয়ালা একজন মুসলমান ব্যক্তি কপালে তিলকওয়ালা একজন হিন্দুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করছেন। এই কার্টুন শেয়ার করার সময় TMD হ্যাশট্যাগের সাথে ‘Noakhali 1946’ লেখা হয়েছে ক্যাপশনে।
সংগ্রহ – The dissent